অসুস্থ প্রকৃতি, আক্রান্ত সংস্কৃতি

বিডি নিউজ ২৪ আলমগীর খান প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৪১

বাঙালি গানের জাতি। গান এই দেশের মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, যেখানে গান লিখতে, বানাতে আলাদা আড়ম্বর লাগে না। মানুষের মুখে মুখে গান জন্মায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, বিয়ের গীত থেকে লালন-হাছন। এসব গানের অনেকগুলো কবে, কখন লেখা হয়েছে জানা নেই, অনেক গানের রচয়িতাও অজানা। তবু গানগুলো টিকে আছে, কারণ এগুলো এই মাটির আম-জাম, তাল-নারকেল, বট-শিমুলের মতোই বাংলার প্রকৃতিতে জন্মেছে।


তবে যে নদী, মাটি ও হাওয়ায় এই গান ও নৃত্যের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সেটাই তো এখন দূষণের শিকার। ফলে গান-বাজনাও যেন কৃত্রিম সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এখন আর স্বাভাবিকভাবে কিছুই জন্মায় না—না ফসল, না শিল্প। যারা এসব চর্চা করছেন তাদের ওই সৃষ্টিও বাজারে ভালো বিক্রি হচ্ছে না। আসলে প্রকৃতি যখন অসুস্থ, তখন সংস্কৃতিই বা কতটা সুস্থ থাকতে পারে?


আবহমান বাংলা সংস্কৃতির এই চাষিরা এখন বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। কেবল প্রাকৃতিক ও পরিবর্তিত সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই নয়, মানবসৃষ্ট দূষণ তথা সহিংস আচরণ তাদের অনেককে, বিশেষ করে বাউল শিল্পীদেরকে, সমাজ থেকে আগাছার মতো উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করছে। অথচ তারা জানেই না যে, সুস্থ ইকোসিস্টেমে আগাছারও এক বিরাট ভূমিকা থাকে। সবকিছু উপড়ে ফেলে আপাতত উচ্চমূল্যের কিছু ফসলের বাম্পার ফলন হলেও, দীর্ঘমেয়াদে সংস্কৃতির ইকোসিস্টেম যে বিপর্যয়ের শিকার হবে তা থেকে আর ফেরা সম্ভব হবে না।


এই চিরন্তন সাংস্কৃতিক আবহ ছাড়াও তাকে অতিক্রম করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল তীব্র প্রাণস্পন্দন নিয়ে, সমাজের নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিসহ একগুচ্ছ মেধাবী নিবেদিত-প্রাণ তরুণের উদ্যোগে। নাটক মানেই সাহসী উচ্চারণ, প্রান্তিক মানুষের স্বার্থরক্ষার অঙ্গীকার, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা—এই ছিল তখনকার মানসশক্তি। বিনোদনের প্রচলিত প্রধান ধারাকে আঘাত করে শুরু হয় এই তারুণ্যের যাত্রা। এর মাঝে নাটক নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনার একটা বড় দিক ছিল। সস্তা আবেগমূলক গল্পকে বাদ দিয়ে বিশ্লেষণমূলক রচনা, মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছে আবেদন, সামাজিক-রাজনৈতিক কুসংস্কার বর্জন, নায়ককেন্দ্রিক ধারা থেকে বেরিয়ে জনতাকেন্দ্রিক ধারা সৃষ্টির চেষ্টা, অভিনয়ের জন্য সুন্দর চেহারা ও সুঠাম দেহের পরিবর্তে বুদ্ধিমত্তা ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন তারা। তাতে অনেকদিক থেকে তারা সফল হয়েছেন। এখনকার বাংলাদেশের বেশিরভাগ খ্যাতিমান অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা মূলত এই নাট্যচর্চা থেকেই উঠে এসেছেন–যা এ দেশের অভিনয়শিল্পকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে গেছে, যার প্রতিফলন সাম্প্রতিক কালের সফল অনেক চলচ্চিত্রেও আছে।


একসময় নাটকের লোকজন শুরু করে নাট্যজগতে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো পথনাটকের চর্চা। এর মূল উৎস সোভিয়েত ইউনিয়নে এজিটপ্রপের মাধ্যমে। এজিটেশন ও প্রোপাগান্ডা শব্দ দুটির মিলনে এজিটপ্রপ দ্বারা বোঝানো হয় আন্দোলন ও প্রচারণা, যা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বলে ঘোষিত। জার্মানিতে ওয়ার্কার্স থিয়েটার, যুক্তরাষ্ট্রে লিভিং নিউজপেপার ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এ ধরনের নাট্যচর্চা ইউরোপ-আমেরিকায় বিস্তৃত হয়েছিল। বাংলাদেশে পথনাটকের যাত্রা সেই পথ ধরেই। কিন্তু যথার্থ শক্তিশালী শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের অভাবে পথনাটক আয়োজিত হয় মূলত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, শহীদ মিনারে ও ব্যস্ত সড়কের মোড়ে। শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলে কম হয়েছে, কারণ শ্রমিক আন্দোলন ও তার স্বার্থকে এখানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পাতিবুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে—ইউরোপ-আমেরিকার মতো শ্রমিক এবং বুর্জোয়া শ্রেণিও এখানে গড়ে ওঠেনি। নাট্য আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠন যা যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দার কালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে যে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়া হয়েছিল ওই সময়কার ব্যতিক্রমী নাট্যদল গ্রুপ থিয়েটারের নামানুসারে ও মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী পার্শ্ববর্তী ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’-এর (আইপিটিএ) অনুকরণের চেষ্টায়।


এত কথা বলার কারণ বাংলাদেশে নাটক নিয়ে এত বিশাল কর্মযজ্ঞের এখনকার পরিণতি, প্রায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার বাস্তবতা। পথনাটক আটকে পড়ে কেবলই হাস্যরসের উৎস হিসেবে। আর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য নাট্যদলগুলোর মঞ্চনাটক মঞ্চের কারিগরি কারসাজি ও অভিনেতাদের চমকপ্রদ অঙ্গভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। জনগণের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থ এড়িয়ে জীবন থেকে দূরবর্তী বিষয়কে আশ্রয় করায় মঞ্চনাটক গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন একসময় ক্ষমতাসীনদের বশংবদ হয়ে পড়ে। তাদের সমালোচনার পরিবর্তে নিশ্চুপ থাকা কিংবা তাদের পছন্দের বিষয়কে নাট্যবিষয় করা— এটাই ছিল দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক চর্চা। আমাদের মঞ্চনাটক ধীরগতিতে সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুরুচি ও সুনীতি চর্চার মাধ্যম হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে একরকম এলিট হয়ে ওঠারও সিঁড়ি। শিল্পকলায় নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখা যে কোনো শ্রেণির মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়—একটা বড় ব্যয় ও প্রয়োজনীয় অবসরের অভাবে, যা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের নেই।


নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বা টিকেটের বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরুর গৌরব প্রচার করলেও নাটককে তারা পেশাদার করতে পারেনি। আবার সিএটি পেশাদার নাটক চর্চার চেষ্টা করেছে নরওয়েজিয়ান অনুদানের ওপর ভিত্তি করে। অন্যদেরকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে হয়েছে। অথচ মঞ্চনাটকের দলগুলো টিকেটের বিনিময়ে নাট্যচর্চাকে এমন বিরাট বৈপ্লবিক কাণ্ড ও পবিত্র মনে করেছে যে, এ থেকে বিচ্যুতি যেন নাট্যজগতের ট্যাবু। শিল্পকলায় বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে যেখানে নাটকের অংশহগ্রহণকারীদের চেয়েও দর্শকের সংখ্যা কম, আর তেমন প্রযোজনা গোটা দশেক করতে পারাই এক বিরাট সাফল্য হিসেবে ধরা হয়—দর্শকের উপস্থিতি ও টিকেট বিক্রির প্রাপ্ত অর্থ বিবেচনা করলে তা এক বীরত্বই বটে। এভাবে অনুদান সংগ্রহের কারণে নাট্যদলগুলোকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কাছেও দায়বদ্ধ হতে হয়েছে— জনগণের কাছে নয়।


তারা নাটককে পেশাদার ও ব্যবসাসুলভ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি। আবার তারা ব্যবসায়ীদের চেয়েও এককাঠি ওপরে থেকেছেন এভাবে যে, নাটক কেউ দেখুক বা না দেখুক তারা তা টিকেটের নির্ধারিত মূল্যের কমে বা বিনামূল্যে দেখতে দিবেন না—এই ভেবে যে তা শিল্পের ও শিল্পীর জন্য অবমাননাস্বরূপ। কেউ দেখুক বা না দেখুক তা নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহারথীদের কোনো ভাবনা ছিল না। ফলে অনেক দুর্বোধ্য ও জীবনবিচ্ছিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এবং নাটকের কয়েকজন লোকই তা দেখে পরস্পরের পিঠ চাপড়ে একে অপরকে উৎসাহিত করেছেন। যারা নাটক দেখতে আসছেন না তাদেরকে নিছকই অসংস্কৃত মনে করে তারা আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছেন। অথচ বিশ্বের নাট্যজগতের সব দিকপালরা তাদের নাটকে দর্শক চেয়েছেন। শেক্সপিয়র থেকে ব্রেখট কিংবা উৎপল দত্ত পর্যন্ত সকলেই চেয়েছেন অশিক্ষিত কর্মজীবী দর্শকের গালি, শিস ও হৈচৈ। আর আমাদের দেশের নাট্যমহারথীরা নাট্যগৃহে কেবলই চেয়েছেন পিনপতন নীরবতা—অর্থাৎ চেয়েছেন ওই সচ্ছল মধ্যবিত্ত যারা হলে গিয়ে একটা রুচিশীল মিষ্টি সময় কাটাতে চান। এমন একটা কিছুর স্বাদ নিতে চান যা থেকে তিনি নিজেকে সমাজের দশজন থেকে উচ্চমার্গের মনে করতে পারেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও