ডিসেম্বর যে অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দেয়
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, অঙ্গীকার ও শপথ গ্রহণের মাস। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধ, সব ধর্মমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন এবং সমতাভিত্তিক ও শোষণমুক্ত জাতি গঠনই হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসের দীক্ষা। কিন্তু স্বাধীনতার ওই বার্তাগুলোর প্রতি কি আমরা স্থির থাকতে পেরেছি? আমাদের শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার অটুট রাখতে পেরেছি? আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মতো রাষ্ট্রীয় দিনগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়ে থাকি। কিন্তু ওই দিবসগুলো উদযাপন করে রাতে ঘুমিয়ে সকালেই দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও দেশের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার থেকে আমরা দূরে সরে যেতে থাকি।
আমরা ধরেই নিই, দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেম প্রকাশ করার জন্য শুধু ওই কয়টি দিনই নির্ধারিত আছে। ওই দিবসগুলো পালন করলেই হয়তো ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ ও দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা সম্পন্ন হয়ে গেল, বছরের বাকি দিনগুলোতে দেশপ্রেম প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই, দরকারও নেই। অথচ বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে সারা বছর একজন নাগরিক যেন দেশপ্রেমের মন্ত্রে অবিচল থেকে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যে সদাতৎপর থাকতে পারে, অন্যায় ও অবিচার না করতে পারে, নিজের প্রতি এবং মা-মাটি, মানুষের প্রতি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, ওই নির্দিষ্ট দিনগুলো তার প্রশিক্ষণ দেয়, শক্তি ও অনুপ্রেরণা জোগায়।
আমরা অনেকেই জানি না, বুঝি না, কীভাবে সারা বছর ধরে দেশপ্রেমের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব। কীভাবে একে ধারণ করব। কীভাবে প্রতিদিন এর প্রকাশ ঘটাব। কীভাবে এ অঙ্গীকার ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ ও বৃহত্তর পরিবেশে জারি রাখব। দেশপ্রেমের প্রকাশ শুধু কয়েকটি দিনের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না। এটি একটি ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ অনুভূতি, এর গভীরতা আছে, বিরাটত্ব আছে। দেশপ্রেম এবং দেশের প্রতি অঙ্গীকার একজন মানুষের দিনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধারণ ও লালন করার বিষয়। এটি সারা বছর জারি রাখার পথ ও পদ্ধতিও আছে।
স্থান, কাল ও পাত্রভেদে দেশপ্রেমের উপস্থাপন এবং তা থেকে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা ভিন্নতর হতে পারে। একজন শিশু এবং একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির কাছে এর উপস্থাপন পদ্ধতি যেমন ভিন্ন হবে, ঠিক তেমনি দুজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত আউটপুটও ভিন্নতর হবে। আমাদের কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক আবার কেউ কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িত, কেউ সম্পদশালী, কেউ আবার কোনোমতে দিন গুজরান করছে। ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ, সৎ চিন্তা-সবকিছুর মধ্যে দেশপ্রেম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরাজমান। প্রতিদিনের নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটাতে হবে। বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের কাজগুলো সম্পন্ন করলেই দেশের প্রতি অঙ্গীকার সমুন্নত হবে।
বৈধভাবে দেশের প্রত্যেক মানুষের সার্বিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো দেশ উন্নয়নের সহজ ব্যাখ্যা। প্রত্যেক মানুষের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়ার অর্থ দেশের সব মানুষের উন্নয়ন, আর সব মানুষকে নিয়েই তো আমাদের দেশ। একজন মানুষ যদি বৈধভাবে নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীলদের উন্নয়নের চেষ্টা করেন, তাহলে তো দেশেরও উন্নয়ন হয়। আর দেশ উন্নয়নের জন্য সব উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও কাজ তো আমার দেশপ্রেমের বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত। তাই বৈধ পথে কেউ যদি কেবল নিজের উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টায়ও রত থাকেন, তবে প্রকারান্তরে তা দেশপ্রেমেরই অংশ।
দেশপ্রেমের বিষয়টি সহজ-সরল ভাষায় সবার বোঝার মতো করে উপস্থাপন করতে হবে। যার জন্য যেটুকু প্রযোজ্য, শুধু ওটুকুই তার সামনে তুলে ধরতে হবে। স্কুলের প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর আগে প্রতিদিন ‘দেশের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখব’ মর্মে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। তখন কিন্তু বেশির ভাগ শিশুই এর অর্থ বুঝতে পারে না; যারা একটু বুদ্ধিমান, তারা মনে মনে ভাবে, দেশসেবার মতো বয়স তাদের হয়নি। কিন্তু ওই বয়সের শিশুর কাছেও দেশ-জাতির প্রত্যাশা আছে। দেশ উন্নয়নে ওই শিশুটিকেও শামিল করতে হবে, তার ভেতরেও দেশপ্রেমের বীজ বপন করতে হবে। তার কাছে দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ হবে-সে তার বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষকদের সম্মান করবে। স্কুলে যেতে আলসেমি করবে না, ঠিকভাবে লেখাপড়া করবে। একটি শিশুর মনে এ কথাটুকু গেঁথে দেওয়া গেলেই যথেষ্ট, এটাই হবে তার দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
খেটে খাওয়া মানুষদের কারও কারও মধ্যে সন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অনেকেই স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ করে না, নেশায় আসক্ত হয়ে স্ত্রীকে অযথা মারধর করে। ওই মানুষটির মধ্যেও দেশের জন্য ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। কিন্তু তাকে কখনোই বোঝানো হয়নি যে, তার জন্য দেশপ্রেম হলো নেশার আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা, স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবাসা, তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা ও সন্তানকে স্কুলে পাঠানো।
মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিখারিরা যখন হাত পাতে, তখন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়াটা সমাজের সামর্থ্যবানদের জন্য অনিবার্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে। স্বনির্ভর জাতি গঠন আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। তাদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বের করে স্বাবলম্বী হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব যে সামর্থ্যবানদের অঙ্গীকারে স্থান পাওয়া দরকার ছিল, তা কিন্তু বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
আমরা প্রতিদিন অন্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলো রুটিনমাফিক উপভোগ করছি। শাশুড়ি-বউ, ভাবি-ননদ দ্বন্দ্ব, পরকীয়ায় ভরপুর নাটক, সিরিয়ালগুলো আমাদের মূল্যবোধ, ঐতিহ্য-আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে যায় না। বাজার প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে আমরা এ বিষয়গুলোতে আর কতকাল মৌন থাকব? মৌনতা একটু দীর্ঘ হলে কিন্তু সম্মতির পর্যায়ে পড়ে যায়।
বিশ্ব এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে। আমরা হয়তো চেষ্টা করেও অনেক কিছু আটকাতে পারব না, যা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়বে; কিন্তু তাই বলে ‘বানের লাহান’ দু’কূল ছাপিয়ে সবকিছু গ্রাস করবে, তা তো হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, অন্যের স্বাধীনতা আমার নাকের ডগা পর্যন্ত, তার বেশি নয়। আমাদের গর্ব করার বন্ধনগুলো আলগা হয়ে যাবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। দেশের সচেতন সুধীমহল বিষয়টি ভেবে দেখলে আমাদের মূল্যবোধকে সম্মান করা হবে বলে বিশ্বাস করি।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেসব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, সেসব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমেই দেশের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধকে এগিয়ে নেওয়া যায়। একজন সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, সরকারি ভূমি দখলকারী, কালোবাজারি, মাদক ব্যবসায়ী, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী বা এদের যারা পৃষ্ঠপোষক, তারা যদি ওইসব কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসে, তবে সেটাই হবে দেশের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশের প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অঙ্গীকার
- বিজয়ের মাস
- শপথগ্রহণ