ভেনেজুয়েলায় কী চান ট্রাম্প
বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা চলছে। গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। আফ্রিকা অশান্ত বহু বছর ধরেই। এসবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থিরতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সে কারণেই সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকায় কয়েক মাস ধরে শুরু হওয়া একটি অস্থিরতা, সেভাবে মনোযোগ কাড়তে পারছে না। এই অস্থিরতা ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে, চাপটা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রই।
ভেনেজুয়েলার শাসক নিকোলা মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল বহু আগে থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, নিকোলা মাদুরো ও ভেনেজুয়েলা নিয়ে মার্কিন নীতি কখনো বদলায় না। অভিযোগ রয়েছে, মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশটিতে সরকার পরিবর্তনেরও চেষ্টা হয়েছে। তবে কোনো না কোনোভাবে টিকে গেছেন মাদুরো। তবে সেই টিকে যাওয়া কিন্তু জনপ্রিয়তায় ভর করে নয়, স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রের সব যন্ত্রকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে।
কয়েক মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার ওপর বেজায় চটেছেন। তাঁর অভিযোগ, ভেনেজুয়েলার কারণে মাদক কারবারসহ নানামাত্রিক অপরাধ প্রশ্রয় পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার হয়ে আসছে। এই অভিযোগের কারণে তিনি ভেনেজুয়েলার মাদক পাচারকারী চক্র দমনে সামরিক বাহিনীকে সক্রিয় করার পাশাপাশি মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকেও (সিআইএ) কাজে লাগাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু মাদক কারবার দমনে এত কিছু কেন? এ যেন মশা মারতে কামান দাগানো!
মাদক কারবার দমনে ট্রাম্পের আয়োজনকে ‘মশা মারতে কামান দাগানো’র সঙ্গে তুলনা করলেও মাদকের এই কারবার কিন্তু ভয়াবহ বৈশ্বিক ব্যাধি। এ ধরনের ‘মশা’ মারতে আসলেই কামান দাগানো উচিত। অবশ্য বিশ্বের কোনো কোনো শাসক নিজের দেশে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে হাজারে হাজারে মানুষ মেরেছেন। এর বড় উদাহরণ ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আছেন। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিচার চলছে।
তবে ট্রাম্প যা করছেন, তার সঙ্গে রদ্রিগো দুতার্তে কিংবা তাঁর মতো স্বৈরশাসক হয়ে ওঠা অন্যদের তুলনা চলে না। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন আপাদমস্তক ব্যবসায়ী। কাজেই তাঁর সব পদক্ষেপের মধ্যে আগে ব্যবসায়িক বিষয়াদি নজরে আনা উচিত। আর সেই ব্যবসায়ী যখন জাতীয় স্বার্থের কথা বলে পদক্ষেপ নেন, সে ক্ষেত্রে কোনো না কোনো গুরুতর কারণ যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। মার্কিন বাহিনী এরই মধ্যে মাদকের চোরাচালান আটকে দিতে কয়েক দফায় ক্যারিবীয় সাগরে ভাসমান নৌকায় বোমা ফেলেছে, তাতে বেশ কয়েকজন নিহতও হয়েছে। ভেনেজুয়েলা থেকে মাদকের চালান আটকে দিতে এই সাগরে মার্কিন বাহিনী রণতরি, যুদ্ধবিমান, বি-৫২ বোমারু বিমান, ড্রোন, গুপ্তচর বিমানসহ বহু কিছু মোতায়েন করেছে। দিনে দিনে সেখানে মার্কিন বাহিনীর শক্তিও বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি ভেনেজুয়েলায় কাজ করতে সিআইএকেও নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। বলা হচ্ছে, মার্কিন বাহিনী কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলে গত কয়েক দশকের মধ্যে এতটা শক্তি প্রয়োগ করেনি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি কিছুদিন আগে ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে ট্রাম্পের এমন আয়োজন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, ট্রাম্প আসলে নিকোলা মাদুরোকে ভয় দেখাতেই এত কিছু করছেন। ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে আগের নীতিতেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটা হলো, মাদুরো সরকারের পতন। এ ব্যাপারে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের লাতিন আমেরিকাবিষয়ক সিনিয়র ফেলো ড. ক্রিস্টোফার সাবাতিনি বিবিসিকে বলেন, সবকিছুই হচ্ছে সরকার পরিবর্তনের জন্য। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভেনেজুয়েলায় আক্রমণ করবে না, সম্ভবত ভয়ভীতি দেখিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে।
বিষয়টা যে আসলেই মাদককেন্দ্রিক কিছু নয়, তা আরও পরিষ্কার হয় মাদকের উৎস বিবেচনা করলে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ মূলত ফেনটানিল নিয়ে চিন্তিত। এই মাদকের মূল উৎপাদনকারী ভেনেজুয়েলা নয়, মেক্সিকো। দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে এই মাদক যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকে। কোকেনেরও প্রধান উৎপাদক ভেনেজুয়েলা নয়, কলম্বিয়া, পেরু ও বলিভিয়া। মার্কিন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট কর্তৃপক্ষের চলতি বছরের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে জব্দ হওয়া ৮৪ শতাংশ কোকেন কলম্বিয়া থেকে এসেছে। প্রতিবেদনে কোকেনের উৎস্য অন্যান্য দেশের নাম থাকলেও নেই ভেনেজুয়েলার নাম। তবে ভেনেজুয়েলার ওপর দিয়ে কোকেনের কিছু চালান যুক্তরাষ্ট্রে আসে। ভেনেজুয়েলা কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা কোকেনের সেই চালান বন্ধে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। অথচ সেই ২০২০ সাল থেকেই মার্কিন বিচার বিভাগ মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক পাচার ও মাদকসংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে।
এর আগে চলতি বছরের গোড়ার দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ভেনেজুয়েলার শাসককে ‘ভয়াবহ স্বৈরশাসক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি কি মাদুরো সরকারের পতন চান—ফক্স নিউজের এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এই নীতিটা নিয়ে কাজ শুরু করতে চলেছি।’ রুবিওর সে মন্তব্যের পর ছয় মাস পার না হতেই কাস্পিয়ান সাগরে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভূরাজনীতি
- বৈশ্বিক অস্থিরতা