কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা
ইউরোপে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ডাইনি শিকার বা উইচ হান্টের নামে ৫০-৬০ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। যাদের মারা হয়, লক্ষ করার বিষয়, সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি। নারী, সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতের মানুষদেরই পুড়ে মরতে হয়েছে বেশি। আপনারা নিশ্চয়ই ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীয় দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওদার্নো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কথা জানেন। তো মধ্যযুগীয় সেই বর্বর সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। সামাজিক উদ্বেগ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক করুণাবস্থা, মহামারি সামাল দিতে না পারা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিরতা। সবকিছু মিলিয়ে তখন সমাজের মানুষের ভেতর প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছিল, পাশাপাশি তাদের ছিল না জ্ঞানের আলো, কাজেই খুব সহজে দোষ চাপিয়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য তারা বেছে নিয়েছিল নারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের। তবে সপ্তদশ শতকের শেষ দিক থেকে যখন বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটছে, যখন আইন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার হচ্ছে এবং যখন মানুষ ধর্মের অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করেছে, তখন ইউরোপীয় সমাজে পুড়িয়ে মারার প্রবণতাও কমে এসেছে। তারপরও বলা যাবে না, তারা পুরোপুরি আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই একবিংশ শতকের বাংলাদেশে ইউরোপের সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিরে এল কেন?
এই প্রশ্নটির উত্তর নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। ৫০০ বছর আগের বাস্তবতার ভেতরেই এর উত্তর নিহিত রয়েছে। সেই উত্তর মাথায় নিয়ে, বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া, গণমাধ্যমে আসা কিছু ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর ও আগুন লাগায় মিছিল নিয়ে আসা একদল লোক। তো এই মব বা দঙ্গল, যাই বলি না কেন, তাদের কয়েকজন নিচতলায় পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে হোটেলটির কয়েকটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সেখান থেকে বিদেশিসহ ২১ জনের দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
২০২৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক ঘটনা হলো, এই মব নুরুল হকের মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পোশাক কারখানার শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরে তাঁকে গাছে ঝুলিয়ে পোড়ানো হয়। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের কটূক্তির নজির তারা পায়নি।
এই ঘটনার পরদিনই, ১৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে দরজায় তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে বেলাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় ঘরের ভেতর আগুনে পুড়ে মারা যায় ওই বিএনপি নেতার সাত বছরের মেয়ে। এ ছাড়া ওই বিএনপি নেতা এবং তাঁর আরও দুই মেয়ে আগুনে দগ্ধ হন।
এসব ঘটনার ভেতর আরও এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যেতে পারত, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তো লেখা হয়ে যেত কালো অধ্যায়টির নাম, শিরোনাম হতো ‘পুড়িয়ে মারা হলো ৩০ জন সাংবাদিককে’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ১৮ ডিসেম্বর এই আয়োজনটাই করা হয়েছিল। সেদিন রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার—এই দুই পত্রিকা অফিসের সামনে আগে মব জড়ো হয় এবং পরে অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, ভেতরে আটকে পড়াদের যখন ফায়ার সার্ভিস বাঁচাতে এগিয়ে আসে, তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয় এই দঙ্গলবাজরা। উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, যেন ভেতরে থাকা প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক পুড়ে মারা যান। নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে এই সাক্ষ্য দেন।
একই সময়ে (১৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছায়ানট ভবনেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই ভবনের ভেতর থাকা নালন্দা স্কুলের শিশুদের জন্য রাখা আসবাব ও বইপত্রও রেহাই পায়নি। ঠিক পরদিনই (১৯ ডিসেম্বর) আগুন লাগানো হয় আরেক ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অফিসে। সৌভাগ্যের বিষয় যে, ছায়ানট ও উদীচী কার্যালয়ের ভেতরে কেউ ছিল না।
বলা হচ্ছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে নাকি পত্রিকা অফিস ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে আগুন ও লুটপাট করা হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। প্রচারের সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজের জীবনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি, বিশেষ করে প্রশাসন। ১২ ডিসেম্বর হাদিকে গুলি করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্যে থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালান। তাঁর দাবি, এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচারণার টিমে যোগ দিয়েছিলেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পুড়িয়ে মারার চেষ্টা