ন্যায় নিশ্চিত হয়েছে
মনীষী জাস্টিনিয়ান বলেছেন, ‘ন্যায়বিচার হচ্ছে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য প্রদান করার দৃঢ় ও বিরামহীন আকাঙ্ক্ষা।’ সেটিই হয়েছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেককে তার প্রাপ্য প্রদান করার যে দৃঢ় ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষ ধারণ করে, সেই প্রাপ্য তাকে প্রদান করা হয়েছে। এটা ছিল চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জনগণের বিরামহীন আকাঙ্ক্ষা। ন্যায় ও সত্যের আলো যেমন সবাইকে উত্তাপ দেয়, তেমনি বাংলাদেশের মানুষ সবাই উত্তাপ অনুভব করছে। এর জন্য বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। যা করা উচিত তা যদি হয় ‘ন্যায়’ তাহলে শেখ হাসিনার প্রতি ন্যায়ের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ন্যায় নিশ্চিত করতে অপারগ হওয়া অন্যায়। সেই অন্যায় থেকে আজ মুক্ত হলো বাংলাদেশ। ন্যায়বিচারের মতো এমন প্রকৃত মহৎ ও ঈশ্বরতুল্য সৎ গুণ আর নেই। গ্রিক রাষ্ট্র দার্শনিক প্লেটো তার মহৎ গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এ ন্যায়ের সন্ধান করেছেন। শক্তিমানের স্বার্থ যে ন্যায় নয়, তাই তিনি নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ শক্তি, মদমত্ততাকে অতিক্রম করে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
১৭ নভেম্বর সোমবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি-১ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন ন্যায়কে সমুন্নত করার জন্যই।
গণ-আন্দোলন ভিত্তিক মানবতাবিরোধী অপরাধ
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের মূল অভিযোগ হচ্ছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনা চরম নির্মমতা প্রদর্শন করে বিক্ষোভ দমন করতে চেয়েছেন। তিনি সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার বশংবদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেভাবেই জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। এটা যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সব বাহিনী ও তার দল আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনগুলোকে সশস্ত্র করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। এ নির্মমতায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন। ২৫ হাজারের বেশি আহত, অঙ্গহানি এবং নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে সরাসরি ৫টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়।
১৫ বছরের গুম, খুন ও গণহত্যা
শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং ভিন্নমত দমন-পীড়নের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ নজির সৃষ্টি হয়। গুম কমিশনে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। গুম কমিশন মনে করে ওই সময়ে গুমের সংখ্যা ৩ হাজার ৫শ ছাড়িয়ে গেছে। শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনায় ওই সময়ে বেশ কয়েকটি গণহত্যা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন চলাকালে মধ্যরাতে হাজার হাজার আলেম ও মাদ্রাসাছাত্রের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার অপরাধে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে আরেকবার আলেমদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সর্বশেষ ২৪-এর আন্দোলনে প্রায় দেড় হাজার মানুষের হত্যার রেকর্ড জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে।
‘বুমেরাং’
১৭ নভেম্বর বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে শেখ হাসিনা যে আদালত গঠন করেছিলেন ২০১০ সালে, তার ১৫ বছর পর সেই আদালতেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন তিনি। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই এ বিচার হয়েছে। এ রায়ের ফলে তাকে ভারত ফিরিয়ে দেবে এরকম সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে দণ্ডিত করার পর একটি বড় প্রশ্ন সামনে আসছে-এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার ফিরে আসা, এমনকি দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয়তো কঠিন হয়ে উঠবে। ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য তাকে ফিরিয়ে আনতে আবারও ভারতের কাছে দাবি জানানোর পথ জোরালো হলো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে দিল্লিকে চিঠি লিখে প্রত্যর্পণের দাবি জানাবে। উল্লেখ্য, এর আগেও ভারতের কাছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যর্পণ আবেদন করা হয়েছিল। তখন ভারত অনুরোধ পেয়েছে, সেটি স্বীকার করা ছাড়া এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি। তবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তির পরের চিঠির জবাবে ভারত বিব্রতকর উত্তর দিতে পারে বলে কূটনীতিক মহল মনে করে। পরে একটি নির্বাচিত সরকার এসেও যদি এ চাপ অব্যাহত রাখে, তবে ভারতের জন্য চুপ থাকা কিংবা শেখ হাসিনা সেখান থেকে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন, তা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সামাজিক ন্যায়বিচার