আমরা কি আবারও ট্রেন মিস করবো?
জুলাই বিপ্লবে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম। আন্দোলনের দিনগুলোতে যেমন রাজপথে ছিলাম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি, কবিতা লিখেছি, ঠিক তেমনি ৩৬ জুলাইতেও রাজপথে নেমে এসেছি নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে সাথেই।
এই ভূমিকাটি এই কারণে লিখলাম যে, জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে অনন্য। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সাহিত্যে কি এর যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে? শুধু সাহিত্যে নয়, আমাদের সামগ্রিক জাতীয় জীবনে জুলাই বিপ্লব কি সার্থক ভূমিকা রাখতে পেরেছে?
বাংলাদেশের জনগণ যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে স্বৈরাচারকে হঠালো তাদের সেই প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে? মনে রাখতে হবে, জুলাই বিপ্লব শুধুমাত্র একটি সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রত্যাশা থেকে জাগ্রত একটি গণ অভ্যুত্থান। গণ অভ্যুত্থান এমনি এমনি হয় না। একটি জাতির বহুদিনের ক্ষোভ, হতাশা ও রাগের বহিঃপ্রকাশ যেমন ঘটে, তেমনি থাকে দেশকে, জাতিকে যেন সঠিক পথে পরিচালিত করা হয় সেই আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছিল দুর্নীতিমুক্ত, অন্য দেশের আধিপত্যমুক্ত , নিজেদের ভাগ্য ও সম্পদ নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারার এবং দেশের উন্নয়নে নিবেদিত একটি শাসনব্যবস্থা।
জুলাই আন্দোলন একদিনের ক্ষোভ থেকে ঘটেনি। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যার কথাই ভাবুন। আবরার ফাহাদকে কেন হত্যা করা হয়? কারণ তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন। ভারতীয় অধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লিখলে ঢাকায় সর্বোচ্চ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের(বর্তমানে নিষিদ্ধ) গুণ্ডারা কেন তাকে হত্যা করলো? কারণ আওয়ামীলীগ সরকার ছিল পুরোপুরি ভারতীয় তাবেদার সরকার। তারা বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থরক্ষা করতে বেশি তৎপর ছিল। তারা বাংলাদেশের জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়নি, তারা ভারতের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল।
সেই কারণে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি। ভোট ডাকাতি করেছে। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কারণ তাদের দরকার ছিল অন্য দেশের সমর্থনে নিজেদের লুটপাট চালিয়ে যাওয়া। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও ছিল ভারতীয় আধিপত্য।
বাংলাদেশের মানুষ চায় সব ধরনের বিদেশি আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন। তারা চায় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে নিজের দেশের কথা শুনতে, নিজের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন দেখতে। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও সিঙ্গাপুর, মালোয়েশিয়ার অবস্থা আমাদের চেয়ে খারাপ ছিল। অথচ এখন তারা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আর আমরা বারে বারে ট্রেন ফেল করেছি।
১৯৪৭ সালে যখন ইংরেজ বিদায় নিল এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলো তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আশা করেছিল যে এইবার দুঃখ, অভাব, বৈষম্য দূর হয়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা ভালো হবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীদের উন্নাসিকতা আর সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলে দেশের উন্নয়নের সেই সুযোগ হারিয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম। কিন্তু সেই সময়ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা, নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলার সুবর্ণ ট্রেনটি আমরা মিস করেছি তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অতিরিক্ত ভারতপ্রীতির কারণে।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী গণঅন্দোলনে আমি একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলাম। মনে আছে নব্বই দশকে এরশাদের পতনের পর আমরা কি পরিমাণ আশাবাদী ছিলাম আর পরবর্তীকালে কি পরিমাণ হতাশ হয়েছি।
জুলাই বিপ্লবের পরও বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিল তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে কি?
- ট্যাগ:
- মতামত
- পেশাগত দায়িত্ব
- জুলাই বিপ্লব