সংরক্ষিত নারী আসন ও সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা

বণিক বার্তা মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩২

সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও আইনি সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নীতি ও ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ একটি দীর্ঘ অবহেলিত বিষয়। এ দেশে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা হলো স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে শত বছরেরও পুরনো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এগুলোয় নারীদের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ শুরু হয়েছে খুবই সম্প্রতি। গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ ও শহরাঞ্চলে পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন উভয় ক্ষেত্রেই গত দশকের শেষভাগে নারীরা কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের ন্যূনতম অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে। ১৯৭৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ ও ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ শুরু হয়। এ সময় প্রথমবারের মতো প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে দুইজন নারী মনোনয়ন পেতেন মহকুমা প্রশাসক কর্তৃক।


১৯৮৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ অনুযায়ী মনোনীত নারী প্রতিনিধির সংখ্যা দুই থেকে বাড়িয়ে তিনজন করা হয়। ১৯৯৩ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৮৩ সংশোধন করে মনোনীত তিনজন নারী সদস্যকে মনোনয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত পুরুষ সদস্য ও চেয়ারম্যানদের ওপর। ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ওপর ভিত্তি করে বর্তমান কাঠামোর ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয় ও এর কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা তিনবার সংশোধন হয়। ১৯৯৭ সালে অ্যাডভোকেট রহমত আলী কমিশনে স্থানীয় সরকার স্তর গঠন প্রক্রিয়ায় উল্লেখ করা হয় যে ‘‌‌ইউনিয়ন পরিষদে তিনটি সংরক্ষিত আসন থাকবে, নারী সদস্যরা প্রতি তিন ওয়ার্ডে একজন, এ ভিত্তিতে পুরুষ ও নারী সবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন’।


১৯৯৭ সালের সংশোধিত অধ্যাদেশের ধারা ৫-এর মাধ্যমে এ বিধানটি বাস্তবায়ন হয়। এ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় মনোনয়নের পরিবর্তে তিনটি সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচনের বিধান প্রচলিত হয়। ফলে প্রথম নির্বাচনে ৪ হাজার ২৭৬টি ইউনিয়ন পরিষদের ১২ হাজার ৮২৮টি সংরক্ষিত আসনে ৪৫ হাজার নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। ইউএন ওমেন-এর ডিসেম্বর ২০২১-এর বৈশ্বিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারে ঐতিহাসিক লিঙ্গবৈষম্য রোধে ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব দ্রুততর করার জন্য বিশ্বের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি দেশ আইন দ্বারা নির্ধারিত লিঙ্গ কোটার ব্যবহার করে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নারী সদস্যরা নির্বাচিত হয়েও মূলধারার একক নির্বাচনী এলাকা না পাওয়ায় তাদের পক্ষে কার্যকরী ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ নির্বাচিত হওয়ার পর নারী সদস্যরা দেখতে পেলেন যে তাদের জন্য নির্ধারিত কার্যাবলি, অফিস, ভাতা ও বাজেট কিছুই নেই। তাদের জন্য ধার্যকৃত নির্বাচিত এলাকায় আরো তিনজন সাধারণ আসনের নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছেন যাদের তুলনায় তাদের দায়িত্ব, কর্তৃত্ব, সম্পদ ও মর্যাদা ভিন্ন।


এমনকি সাধারণ আসনের সঙ্গে তাদের কার্যাবলির বিভাজন বা সমন্বয়ের ও কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া বড় তিনটি ওয়ার্ডে সাধারণ আসনের প্রতিনিধিরা তাদের নির্বাচনী এলাকার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করেন। যদিও অনুশীলনে এটি সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এছাড়া সংরক্ষিত আসনগুলো অন্য তিনটি সাধারণ আসনের সঙ্গে দ্বৈধতা সৃষ্টি করে। ফলে একই আসনের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য দুইজন। এ কারণে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কাজেই স্থানীয় সরকারের তিনটি স্তরে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিত্বের অন্তর্ভুক্তির কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ এবং সাধারণ আসনগুলোর সঙ্গে সংরক্ষিত আসনের দ্বৈধতা সৃষ্টি হওয়া ছিল এ আইনটি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায়। ফলে নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হন। আইনটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় অনেক অসংগতি সৃষ্টি হয়।


সংরক্ষিত আসনটির অকার্যকারিতা প্রথম নির্বাচনের পর পরই প্রমাণ হলেও এ আইনটির সংশোধনের জন্য কোনো মহলই এগিয়ে আসেনি, যা নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতি নারী প্রধান সরকার থাকার পরও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ও অকার্যকর আইনটির পরিবর্তন করা হয়নি। তবে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি, ‘‌স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর সদস্য সংখ্যা’ শিরোনামে নারী প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কমিটি বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নারী সদস্যদের অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বের সংখ্যাগত কাঠামো কী হবে তা নির্ধারণের জন্য বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।


কমিটি সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের কর্তৃক তাদের জন্য একক কোনো নির্বাচনী এলাকা বা ওয়ার্ড না থাকায় তারা দায়িত্ব পালনে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি ‘‌পরবর্তী তিনটি নির্বাচনের জন্য প্রতি স্তরের স্থানীয় পরিষদে ৪০ শতাংশ নারী আসন ঘূর্ণায়মান (Rotation) পদ্ধতিতে এককভাবে নির্ধারণ করার সুপারিশ করেন’। এ সুপারিশ মোতাবেক কমিটি ‘‌পরবর্তী তিনটি নির্বাচনের জন্য প্রতি স্তরের স্থানীয় পরিষদে প্রথম নির্বাচনে ৪০ শতাংশ, দ্বিতীয় নির্বাচনে ৪০ ও তৃতীয় নির্বাচনে ২০ শতাংশ নারী আসন এককভাবে নির্ধারণ করার সুপারিশ করেন’। এ সুপারিশ মোতাবেক স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ), পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ-২০০৭ তৈরি করা হয়। তবে শর্ত থাকে যে নির্ধারিত আসনবহির্ভূত আসনে নারী প্রার্থীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারবেন।


বিধানটি পৌরসভা অধ্যাদেশ ধারা (৯), সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ ধারা ২৮-এ মহিলা আসনের ৪০ শতাংশ নির্ধারিত আসন পর্যায়ে ঘূর্ণায়মান (Rotation) পদ্ধতিতে রাখতে হবে এবং ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থা সরকার নির্বাচন কমিশনের সহিত পরামর্শক্রমে গেজেটে প্রকাশ করবে। তার পরও রহস্যজনকভাবে স্থানীয় সরকারের এসব অধ্যাদেশে উল্লেখিত ৪০ শতাংশ ওয়ার্ডভিত্তিক নারী প্রতিনিধিত্বের নতুন বিধানটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং অদ্যাবধি বিদ্যমান প্রথাই বহাল রাখা হয়, যা সংবিধানবিরোধী ও বেআইনি। খুলনা সিটি করপোরেশনের কমিশনারদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে নতুন পরিপত্র কার্যকর না হওয়ার ১০ বছর পর ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯-এর ৬১ নং ধারা সংশোধন করে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যদের ক্ষমতা ও বিশেষ কার্যাবলি) বিধিমালা, ২০১৬ প্রণয়ন করে (সূত্র: তারিখ: ১৪ আশ্বিন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ/২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ)।


ওই বিধিমালা অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের ওয়ার্ড সভায় উপদেষ্টার দায়িত্ব, এক-তৃতীয়াংশ স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব ও এক-তৃতীয়াংশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব প্রদান সদস্যদের বিধানিক ভূমিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সভাপতির দায়িত্ব প্রদানসহ আইনের ৩৮ ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের পরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুবিধার্থে আরো বেশকিছু দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু মূল সমস্যার (প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতা কাঠামোর) কোনো পরিবর্তন হয়নি বিধায় কিছু দায়িত্ব ভাগাভাগি করার পরও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের অবস্থানগত কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও