পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর: যেভাবে রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দিয়েছিল
প্রায় সাড়ে ১২ বছর আগে ‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন’ শিরোনামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায়। ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও দিনটি রয়ে গেছে জন-আলোচনায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হয়েছে, তার মধ্যে ৭ নভেম্বর অন্যতম। দিনটি দেশের পরবর্তী রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে।
আমরা কেউ কেউ মোটাদাগে দিনটির ব্যবচ্ছেদ করতে বসি। তিনটি পক্ষ খোঁজার চেষ্টা করি। এই তিন পক্ষের কেন্দ্রে আছেন ওই সময়ের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের। এটা কি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল? নাকি এর পেছনে ছিল রাজনীতি?
আমরা অনেক কিছুই জানি না। আমরা অনুমাননির্ভর কথাবার্তা বলতে পারি। তাঁদের মধ্যে একমাত্র তাহের কিছু কথা বলে গেছেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাবে সামরিক ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে। খালেদ কোনো কথা বলার সুযোগ পাননি। জিয়া এরপরও বেঁচে ছিলেন প্রায় ছয় বছর। তিনি এ নিয়ে মুখ খোলেননি। তাঁদের নিয়ে অন্যরা নানান কথা বলেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেসব ব্যাখ্যায় পক্ষপাত আছে, আছে জয়ীকে ন্যায্যতা দেওয়ার ও পরাজিতের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা। এ নিয়ে এখনো যথেচ্ছ রাজনীতি হয়।
৭ নভেম্বরের সুলুকসন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একাত্তরে। ২৫ মার্চ মাঝরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালালে মানুষ দিশাহারা হয়ে যায়। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে যাঁরা এত দিন রাজপথ কাঁপিয়েছেন, তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে ছোটেন সীমান্তের দিকে। পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী আর সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তাঁরা পিছু হটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢোকেন।
৪ ও ৫ এপ্রিল কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় একটি চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয় প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন। সেখানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ ও রফিকুল ইসলাম। উপস্থিত হয়েছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। কীভাবে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হলেন, এটি একটি প্রশ্ন। তাঁরা সবাই ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের আওতায় ছিলেন। শুরুর দিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাঁদের সব ধরনের সহায়তা দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংগঠিত হওয়ার আগেই সামরিক নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল। তাঁরা একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
কাকতালীয়ভাবে ওই সময় নয়াদিল্লিতে মঞ্চস্থ হচ্ছিল আরেকটি দৃশ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের। বৈঠকে ভারতের কয়েকজন শীর্ষ মন্ত্রী, আমলা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বিএসএফের মুখ্য আইন কর্মকর্তা এন এস বেইনস স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করে দেন। তাজউদ্দীনের একটি বেতার ভাষণ রেকর্ড করা হয়। এই সরকার প্রকাশ্যে আসে ১৭ এপ্রিল।
একাত্তরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল জোড়াতালি দেওয়া। কেউ কাউকে মানেন না। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা বিএসএফের সাহায্যে সীমান্ত এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেষ্টা ও তত্ত্বাবধানে ৫-৬ জুলাই শিলিগুড়িতে ১৯৭০ সালের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন। সরকার কিছুটা থিতু হয়। জুলাইয়ের শেষ দিকে কলকাতায় বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেন। বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিরোধযুদ্ধে সংহতি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে।