আইএমএফের শর্তের লাভ-ক্ষতি

www.ajkerpatrika.com শোয়েব সাম্য সিদ্দিক প্রকাশিত: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৫

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একদিকে আছে দ্রুত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের নির্ভরতা ও বৈশ্বিক অস্থিরতার চাপ। এই বাস্তবতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। সংস্থাটি আমাদের কাছে একদিকে আর্থিক সহযোগী, অন্যদিকে কঠিন শিক্ষক, যে সহায়তা দেয়, কিন্তু শর্তও দেয়। কেউ বলেন, আইএমএফ ছাড়া চলা কঠিন, আবার অনেকে মনে করেন আইএমএফের শর্ত মানলে দেশ পিছিয়ে যায়। বাস্তবতা হলো, এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেই সত্য লুকিয়ে আছে।


বাংলাদেশ ২০২৩ সালে আইএমএফ থেকে প্রায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ নেয়। এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য ছিল রিজার্ভের ঘাটতি পূরণ করা, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। কোভিড-পরবর্তী সময়, জ্বালানি-সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন এক কঠিন অবস্থায় ছিল। ডলার বাজারে অস্থিরতা, আমদানিতে বাধা, মুদ্রাস্ফীতি এবং রেমিট্যান্সের অনিয়মিত প্রবাহ—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি চাপে পড়ে। আইএমএফ তখন আসে একধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু এই সহায়তা শুধু অর্থ দেওয়ার মধ্যে আটকে ছিল না, বরং পুরো নীতির দিকনির্দেশনাও বদলে দেয়।

আইএমএফ মূলত চায় অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা। তারা মনে করে, ভর্তুকি কমাতে হবে, করজাল বাড়াতে হবে, মুদ্রানীতি বাজারভিত্তিক করতে হবে, বিনিময় হার বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে শৃঙ্খলা আনতে হবে। তাদের মতে, এই নীতিগুলো মানলে দেশের অর্থনীতি টেকসই পথে চলবে। আসলে, বিশ্বব্যাপী আইএমএফ একই মডেল অনুসরণ করে—‘আগে হিসাবের ভারসাম্য, পরে মানুষের স্বস্তি’।

এখানেই বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে আইএমএফের তত্ত্বের সংঘর্ষ তৈরি হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর, আমদানিনির্ভর এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসানির্ভর। এখানে ছোট ব্যবসা, কৃষি এবং প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন চলে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী যখন জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানো হয়, তখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়। এতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কৃষকের খরচও বাড়ে। ফলে সবকিছুর দাম বাড়ে, কর্মসংস্থান কমে যায়, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।


তবু আইএমএফের কিছু দিক নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। প্রথমত, তারা অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে চায়। রিজার্ভের হিসাব, রাজস্ব ঘাটতি এবং বাজেট পরিকল্পনায় তারা জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চায়। দ্বিতীয়ত, তাদের কারণে সরকারকে কিছু কাঠামোগত সংস্কারের পথে যেতে হয়, যেমন কর প্রশাসন আধুনিক করা, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমানো এবং সুদের হার বাজারভিত্তিক করা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে আইএমএফের উপস্থিতি মানে বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি আস্থার সংকেত। যেমন আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের পর বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকার মতো সংস্থাগুলো নতুন করে সহযোগিতায় আগ্রহ দেখায়। এতে বাজেটে টাকার প্রবাহ কিছুটা বাড়ে এবং স্থিতিশীলতার বার্তা ছড়ায়।


তবে এর পাশাপাশি নেতিবাচক দিকগুলোও স্পষ্ট। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে সরকারকে ধীরে ধীরে জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ এবং সামাজিক খাতে ভর্তুকি কমাতে হয়। এতে সমাজের নিচের স্তরের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। একদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, অন্যদিকে আয় বাড়ে না। এতে বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


সুদের হার বাজারভিত্তিক করার বিষয়টিও এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে ব্যাংকগুলো একটি নির্দিষ্ট সীমায় ঋণ দিত, ফলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলেন। এখন সেই সীমা তুলে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো ঝুঁকি বিবেচনা করে সুদের হার বাড়াচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নতুন ব্যবসায়ী ঋণ পেতে সমস্যায় পড়ছেন। শিল্প খাতে বিনিয়োগের গতি কমছে, নতুন চাকরির সুযোগও কমছে। অর্থনীতি কাগজে স্থিতিশীল মনে হলেও বাস্তবে তা কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ছে।


আরেকটি বড় বিষয় হলো, আইএমএফের নজর রাজস্ব আদায়ে। তারা চায় বাংলাদেশ কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াক। হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের রাজাওয়ালি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম, প্রায় ৯ শতাংশের মতো। তাই আইএমএফ বলছে করজাল বাড়াতে হবে। কিন্তু যদি তা হয় শুধুই চাপ দিয়ে, তাহলে তা উল্টো ফল দেয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ এখনো জটিল, যেখানে কর রিটার্ন দেওয়া অনেকের জন্য কঠিন। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, কর প্রশাসনকে আধুনিক করা জরুরি, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে করদাতাদের সেবা দেওয়ার অবকাঠামো এখনো দুর্বল।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও