অসময়ের বৃষ্টিতে যখন শ্রাবণের ভরা বর্ষা মনে পড়ে, তখন বুঝতে হবে প্রকৃতির রোষ কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থার’ প্রভাবে গত সপ্তাহে যে ভারী বর্ষণ হয়েছে, তা যেন সেখানকার কৃষকের ওপর নেমে আসা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। আগাম ভালো দামের আশায় যে আলু, শর্ষে বা পেঁয়াজের বীজ কৃষক বুনেছিলেন, মাত্র দুই দিনের আকস্মিক বন্যায় তা পচে গেছে। আমাদের কৃষকদের সুখের দিন আজীবন যেন অধরাই থেকে গেল।
কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে রাজশাহী জেলার ৩০৮ হেক্টরের বেশি জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এই ক্ষতি কেবল অর্থের নয়, এটি সেখানকার ৪ হাজার ২০০ কৃষকের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও শ্রমের অপমৃত্যু। রাজশাহীর কৃষকেরা সাধারণত নভেম্বর মাসকে শুষ্ক মৌসুম হিসেবেই জানেন, যখন আগাম ফসল তুলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। কৃষকদের লক্ষ্য ছিল দ্রুত ফসল তুলে পরের মৌসুমের প্রস্তুতি নেওয়া; কিন্তু নভেম্বরের এই অতিবৃষ্টি তাঁদের পুরো হিসাব উল্টে দিয়েছে।
আলু, শর্ষে, পেঁয়াজ ছাড়াও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পানের বরজে। আধা পাকা আমন ধানও তলিয়ে গেছে। হেলে পড়া ধান কাটতে শ্রমিকের খরচ বাড়ছে আর কৃষক বলছেন, খরচের টাকাও উঠবে না। কেবল বৃষ্টির পরিমাণই সমস্যা নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূপ্রকৃতিও এই ক্ষতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঠের চারদিকে পুকুর ও অন্যান্য স্থাপনা থাকায় বহু জমিতে পানি নামতে পারছে না, যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।
যদিও কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা মাঠে গেছেন এবং ক্ষয়ক্ষতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সংকট নিরসনে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী? প্রতিবছরই যদি নভেম্বর বা ডিসেম্বরে অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিতে এমন সর্বনাশ ঘটে, তবে কৃষকদের আগাম চাষের কৌশলই ভুল প্রমাণিত হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যেন তারা আসন্ন রবি মৌসুমের জন্য নতুন করে বীজ ও সার কেনার সাহস পান। সেই ক্ষতিপূরণ সহজে এবং সময়মতো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের হাতে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিবিজ্ঞানীদের উচিত হবে নভেম্বরের শেষভাগেও এমন উপযোগী আগাম আলু, শর্ষে ও ধানবীজ উদ্ভাবন করা, যা সাময়িক বৃষ্টি সহ্য করতে সক্ষম। স্থানীয় প্রশাসন ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিএমডিএ) সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে। প্রয়োজনে খাল বা ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও খনন করতে হবে। কৃষকদের কাছে অন্তত স্থানীয় ও নির্ভুল আবহাওয়ার পূর্বাভাস পৌঁছানোর ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, যাতে তাঁরা শেষ মুহূর্তেও দ্রুত ফসল তোলা বা রক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অসময়ে বৃষ্টি
- ফসলের ক্ষতি