অনেক জল্পনার পর বিএনপি ২৩৭ টি সংসদীয় আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বলা হচ্ছে এরা সম্ভাব্য প্রার্থী। প্রয়োজনে দল মনে করলে যে কোন সময় এই প্রার্থিতা বদল হতে পারে। বিএনপির এই সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে ৮৩ জন আছেন এবারের নির্বাচনে নতুন প্রার্থী। ১০ জন আছেন নারী। ৪ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এসব প্রার্থীর মধ্যে পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করা প্রার্থী আছেন বেশ কয়েকজন। বিএনপির এই প্রার্থী ঘোষণার কতগুলো বৈশিষ্ট্য খুব সুস্পষ্ট–
ক). পুরাতন যারা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন এবং আছেন তাদের সিংহভাগকে সংসদ সদস্য হিসাবে দলের দেখতে চাওয়া।
খ). বর্ষীয়ান নেতাদের বা পুরনো নেতাদের অনেকের পুত্র-কন্যা বা পরিবারের সদস্যদের রাজনীতির মাঠে পরবর্তী-প্রজন্ম হিসাবে আগমন নিশ্চিত করা।
গ). এক পরিবারে একাধিক প্রার্থী না দেওয়া। একমাত্র ব্যাতিক্রম জিয়া পরিবার।
ঘ). মাঠের ত্যাগী নেতাদের লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেওয়া।
ঙ). বেগম জিয়াকে এই নির্বাচনে প্রধানতম ইমেজ হিসাবে মাঠে আনা। সেকারণেই তিনি ফেনী, বগুড়া ও দিনাজপুর এই তিনটি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এটা অনেকটাই প্রতীকীভাবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ত্যাগ ও সংগ্রামকে ভোটারদের কাছে নতুন ভাবাবেগ তৈরির প্রয়াস, যা বিএনপির ভোটের মাঠকে উজ্জীবিত করবে বলে তাদের ধারণা।
চ). নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বিএনপির পুরনো নেতাদের অনেকেরই অতীত ইমেজ খুব উজ্জ্বল না হলেও গত ১৮ বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে অংশগ্রহণ ও মাঠপর্যায়ে দলকে টিকিয়ে রাখার কষ্টকর সংগ্রামকেই দল মূল্যায়ন করেছে এই নির্বাচনি মনোনয়নে। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার চাইতে দলের সংগ্রাম ও লড়াইয়ে অবদানকেই বিএনপি নেতৃত্ব গুরুত্ব দিয়েছে বেশি।
ছ). দেশের রাজনীতিতে প্রজন্মান্তর ঘটছে। বয়স্ক ও পুরনোদের অনেকেরই শারীরিক অবস্থা আর রাজনীতির অনুকূল নয়। বয়স্ক নেতাদের রাজনীতির ব্যাটনের পালাবদল ঘটছে নতুন প্রজন্মের আগমনের মধ্য দিয়ে। বিএনপি এই মনোনয়নে সেখানেও আলো ফেলেছে। এখানে পরিবারতন্ত্র যেমন বিবেচনায় এসেছে, তেমনি ছাত্রদল-যুবদলসহ পেশাজীবীদের জাতীয়তাবাদী অংশের অনেকেরই জায়গা হয়েছে। বিএনপিতে উত্তর প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের একটা আগমন এই নির্বাচনি মনোনয়নে স্পষ্ট হয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন, অতঃপর
বিএনপির নির্বাচনি প্রার্থী ঘোষণা ভোটের রাজনীতিতে একটা নতুন বার্তা। এটা এখন সুস্পষ্ট দেশ একটা ভোটের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে, দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। এই নতুন অধ্যাদেশ কিছু ইংগিতও দিয়েছে, কেমনতর হবে আগামী সংসদ নির্বাচন।
প্রথমত, নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে—এমন বিধান যুক্ত হয়েছে এই আদেশে। ফলে যেসব ছোট দলের বড় নেতারা বিএনপি বা অন্য বড় দলের ভোটব্যাংকের সুবিধা নিয়ে নির্বাচণি বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ দেখছিলেন তাদের স্বপ্ন বিবর্ণ হতে পারে। তারা পড়বেন বিপাকে। তাদের জন্য বিএনপির ভোটব্যাংকের সুবিধা নিয়ে ভোটে জেতা কঠিন হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই নির্বাচনি জোট গঠনের চলমান হাওয়া অনেকটাই বদলে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে এই অধ্যাদেশে। ফলে নির্বাচনে সশস্ত্রবাহিনী অধিকতর সক্রিয় থাকার আইনি সুযোগ পাচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনি দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এটি নির্বাচনকে হাঙ্গামা মুক্ত করার সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সুষ্ঠু ভোট হওয়ার সুযোগ তাতে বাড়তে পারে।
তৃতীয়ত, সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো আদালত–ঘোষিত পলাতক আসামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের নির্বাচন করার সুযোগ তাতে রহিত হবে।
চতুর্থত, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে পারবেন না। সেখানে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা থাকবে। ফলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ার সুযোগ থাকছে না। সেটাও নির্বাচনকে আমেজপূর্ণ করতে পারে।
ভোটের মাঠে সুষ্ঠু হাওয়া বওয়াতে এই সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) নতুন অনুঘটকের কাজ করতে পারে।
জামায়াত, এনসিপি এবং অন্যান্য ইসলামি দল
ভোট যত এগুতে থাকবে ততই নতুন মেরুকরণের চেহারা সুস্পষ্ট হতে থাকবে। জামায়াতে ইসলামী অপরাপর ইসলামি দলগুলোকে যুক্ত করে ভোটের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে চাইবে। নির্বাচনে একটা ভারতবিরোধী হাওয়া তুলবে তারা। এনসিপি নানা সমীকরণ শেষে জামায়াত না বিএনপি কার সঙ্গ নেবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। তবে শাপলা কলির প্রতীকে তারা বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টাতেই এগিয়ে থাকবে। বিএনপিও চাইবে ন্যুনতম ছাড় দিয়ে তাদেরকে জোটভুক্ত রাখতে। দরকষাকষিতে না মিললে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের ঝুঁকিও নিতে পারে এনসিপি। তবে ভোটাররা জোটের চাইতে প্রার্থীর গুণাগুণকে বিবেচনায় নিতে আগ্রহ দেখাতে পারেন। এবার ভোটের মাঠে তরুণদের একটা বড় অংশকে লড়াই করতে দেখা যাবে। ইসলামি দলগুলো কতটা ঐক্যবদ্ধ হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে ভোটের মাঠের আওয়াজে তারা সক্রিয় থাকবে বিপুলভাবে। জামায়াতে ইসলামী কৌশলে ও প্রচারণায় এগিয়ে থাকবে। তবে ভোটের অংকে তা কতটা প্রভাব রাখবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
নতুন ভোটার সমাচার
এবার ভোটের মাঠের বড় খেলোয়াড় হচ্ছে নারী ও নতুন ভোটার। ১২ কোটি ৭৬ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ভোটার নতুন এবং জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। তাদের ভোটের অতীত কোনো রেকর্ড নেই। তাই এদের ভাবনা অনুমান করাও মুশকিল। এখন পর্যন্ত এই ভোটারদের মনোভাব কিছুটা দেখা মিলেছে কেবলমাত্র ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু ভোটে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভোট দিয়ে সারাদেশের মাঠের ভোট মাপার প্রক্রিয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে, এই নতুন ভোটাররা ভোটের মাঠে কি প্রভাব ফেলবে সেটা ভাবা কঠিন। তবে গতানুগতিক পরিসংখ্যানের সকল পূর্বানুমানকে এই নতুন ভোটাররা বদলে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই নতুন ভোটারের চ্যালেঞ্জ বড়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। যারা তাদের মন জয় করতে পারবেন তারাই ভোটের মাঠে সুফল পাবেন।
ভোটের মাঠে সোশাল মিডিয়া
ভোটের মাঠকে এবার গরম রাখবে সোশাল মিডিয়া। বিশেষ করে প্রতিটি আসনের স্টার প্রার্থীদের অতীত কর্মকাণ্ডে কোনো নেতিবাচকতা থাকলে তথ্যসহ সেসব সামনে আসবে। বারবার তা ভোটারদের চোখের সামনে হাজির হবে। প্রতিটি প্রার্থী থাকবেন সোশাল মিডিয়ার দারুণতর ওয়াচে। তাদের যে কোন চ্যুতি মুহুর্তেই ছড়িয়ে যাবে ভোটারদের মোবাইলে। যেসব নেতারা মারদাঙ্গা রাজনীতি করেই এতদূর এসেছেন তাদের জন্য এই পরিস্থিতি মোকাবিলা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। আবার অনেকেই এই সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে তার ইমেজ বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন। কোন দলের কোন প্রার্থী কিভাবে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন, তার একটা প্রভাব পড়বেই এবারের নির্বাচনে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাল ও নির্বাচন
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে থাকবে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ততই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবর্তিত হতে থাকবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও সক্রিয় করে তুলবে। বিএনপি তাতে চাপে পড়তে পারে। বিশেষ করে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) জারি করে সরকার প্রমাণ করেছে অনেক বিষয়েই তারা নিজেদের মত করে চলবে। সম্ভবত মুহম্মদ ইউনূস একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কঠোর থাকবেন। তার প্রতিটি চাল রাজনীতি ও নির্বাচনকে জটিল করে তুলতে পারে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর লোকবলের জোর হালে পানি নাও পেতে পারে। মাথা না খাটিয়ে গায়ের জোরের শক্তিতে জেরবার হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো।