মাসে ৪০০ অভিবাসীর মৃত্যু : রাষ্ট্রের কাছে কি শুধু সংখ্যা?
খবরে দেখলাম দেশে প্রতিমাসে ৪০০ অভিবাসী শ্রমিকের লাশ আসে। প্রথমে খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু পড়ে দেখলাম সবই সরকারি তথ্য। প্রতিবছরই লাশের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ জনের লাশ এসেছে দেশে। সবচেয়ে বেশি লাশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, প্রতি মাসে গড়ে ৪০০ এবং দিনে গড়ে ১৩ জনের লাশ দেশ আসে। আর ২০২৫ সালে প্রথম মাসেই লাশ এসেছে ৪৪৭ জনের। অনেক লাশ বিদেশের মাটিতেই দাফন করা হয়। অনেক পরিবার লাশ দেশে আনতে চান না।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে প্রবাসীদের লাশ আসার সংখ্যা বাড়ছে। কেন এই হারে অভিবাসী শ্রমিক মারা যাচ্ছেন? এর উত্তর পাওয়া কঠিন। কারণ অধিকাংশ মৃতের ময়নাতদন্ত করা হয় না পরিবারের অসম্মতিতে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, কোনও রোগে মারা গেলে সেটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়। মন্ত্রণালয় বলছে, প্রবাসীদের লাশ সবচেয়ে বেশি আসে সৌদি আরব থেকে। এছাড়াও জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাশ দেশে আসে।
প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর কারণ জানতে সরকারিভাবে কোনও গবেষণা করা হয়নি। সরকার মনে হয় কর্মী পাঠিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করে। হয়তো মাসে ৪০০ অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু তাদের কাছে সংখ্যা মাত্র। এই দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো কত কষ্ট করে আয় করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে চালু রেখেছেন, এ কথা ভুলে যায়।
মক্কা থেকে মদীনা যাওয়ার পথে দেখেছি দু’পাশে ধু-ধু মরুভূমি। কোথাও কোনো বৃক্ষ নেই, আছে ছোট ছোট কাঁটা ঝোপ। এমনকি কাজের ফাঁকে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মাথা গোঁজার মতো যথেষ্ট তাঁবুও নাই। অসংখ্য মানুষ কাজ করছে এর মধ্যেই। রাস্তা থেকে দেখেই মনে হয়েছে কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে মরুভূমিতে গিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হওয়ার কথা।
আমার খুব কষ্ট হয়েছিল মানুষগুলোকে দেখে। মনে হয়েছে এনাদের যখন-তখন হিট স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। কারণ এনারা এতো গরমে কাজ করে অভ্যস্ত নন। জমিজমা বিক্রি করে, মোটা সুদে ঋণ নিয়ে, পরিবার ছেড়ে ভীষণ কষ্টের একটা জীবন বেছে নিয়েছেন শুধু দেশে রেখে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটাবেন বলে। সেই সাথে দেশ হবে স্বনির্ভর।
বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানলাম, প্রবাসীকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত বা ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে। মৃতদের একটা বড় অংশই মধ্যবয়সী কিংবা তরুণ। এছাড়াও হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, কিংবা প্রতিপক্ষের হাতেও খুন হন বাংলাদেশিরা। এসব মৃত্যু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগই মারা গেছেন ৩৮ থেকে ৪২ বছরের মধ্যে এবং কাজে যোগদান করার অল্প সময়ের মধ্যে। কী ভীষণ কষ্টদায়ক তথ্য।
বিদেশে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর হার এত বেশি কেন তা কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। আবার এত বেশি কর্মী স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাকে কেন মারা যাচ্ছেন তার সঠিক কারণ জানতেও অনুসন্ধান করা হয়নি। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ওই দেশ থেকে যা লেখা হয় তাও আর খতিয়ে দেখা হয় না। প্রবাসী কর্মীদের অভিযোগ, কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ এড়াতেও স্ট্রোকে কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কথা ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয় অনেক সময়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু