ঘটনার পর যে গল্প বলা হয়, সেটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি

বিডি নিউজ ২৪ কৌশিক আহমেদ প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৮

রাজনৈতিক হত্যা, হত্যাচেষ্টা বা সহিংসতার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক বাস্তবতা হলো, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ব্যাখ্যা তৈরির প্রতিযোগিতা। গুলির শব্দ থেমে যাওয়া মাত্রই কারা এটি করেছে এবং কেন করেছে, তা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য জনপরিসরে ঘুরতে শুরু করে। কখনও মনে হয়, এসব সম্ভবত আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। কিছু মানুষ সত্যিই ক্ষুব্ধ হয়ে নিন্দা প্রকাশ করেন, কিন্তু রাজনীতির মাঠে নিন্দাও নিরপেক্ষ থাকে না; নিন্দাকে এমনভাবে প্যাকেজ করা হয় যাতে তা নিজ নিজ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে।


শরীফ ওসমান বিন হাদির বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। ইনকিলাব মঞ্চের এই নেতা বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখার কথা জানায়, পরে প্রাথমিক অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ারে নেওয়ার খবরও আসে।


রাজনীতির মাঠে সক্রিয় বড় দল বিএনপি দ্রুতই এ হত্যাচেষ্টাটিকে নির্বাচনি পরিবেশ বানচাল করার নীলনকশা এবং একটি চক্রের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার বলে বর্ণনা করেছে, অর্থাৎ হামলাকে তারা একটি বৃহত্তর অস্থিরতাসৃষ্টির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফ্রেম করেছে। রাজনৈতিকভাবে এই ফ্রেমিংয়ের সুবিধা হলো, এতে হামলার তদন্তের নির্দিষ্ট ধাপে না গিয়েও আগেভাগে একটি বড় গল্প দাঁড়ায়, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার দায় সরকার ও প্রশাসনের ঘাড়ে আসে এবং সমর্থকদের দ্রুত সংগঠিত করা যায়। একই সঙ্গে কারা লাভবান হচ্ছে এই প্রশ্নটি, কারা কাণ্ডটি ঘটিয়েছে, সেই প্রশ্নকে চাপা দেয়, ফলে ঘটনা তদন্ত-নির্ভর না হয়ে ব্যাখ্যা-নির্ভর হয়ে ওঠার ঝুঁকি বাড়ে।


জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্যে আরেক ধরনের ফ্রেমিং দেখা যায়। তিনি সহিংসতাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন এবং দ্রুত, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ তদন্তের দাবি তুলেছেন। আবার তিনি এটাও বলেছেন যে ঘটনা প্রমাণ করে সমাজের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল অস্ত্র আছে এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসী ধরাকে সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত হিসেবে টেনেছেন। এখানে লক্ষ্য করুন, অস্ত্র আছে এবং সন্ত্রাসী আছে বলা হচ্ছে, কিন্তু কারা, কোন নেটওয়ার্ক, কোন পৃষ্ঠপোষকতা, এসবের দিকে না গিয়ে কথাটি দ্রুতই নির্বাচন-সম্পর্কিত নৈতিক শর্তে রূপ নেয়। এতে নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে একটি চাপ তৈরি হয়, কিন্তু একই সঙ্গে তদন্তের বাস্তব কাঠামো, অপরাধের লজিস্টিক, অর্থের উৎস, অস্ত্রের উৎস, নিরাপত্তা ব্যর্থতার নির্দিষ্ট জায়গাগুলো আলোচনার বাইরে থেকেও যেতে পারে। এর পাশাপাশি ডাকসু ভিপির বক্তব্য মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় রাষ্ট্রের ওপরে আস্থা না রেখে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার একটা হুমকিও রয়েছে। ডাকসু ভিপি সাদিক সাদিক কায়েম ফেইসবুকে লিখেছেন, “ওসমান হাদিকে গুলি করা হল। চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টারদের কবল থেকে ঢাকা সিটিকে মুক্ত করতে অচিরেই আমাদের অভ্যুত্থান শুরু হবে। রাজধানীর ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানাচ্ছি।“


এর পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘটনার আরেকটি রাজনৈতিক পাঠ হাজির করেছে। তারা বলেছে হামলাটি শুধু একজন প্রার্থীর ওপর নয়, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ওপর আঘাত এবং তারা অভিযোগ করেছে যে হামলার আগে প্রকাশ্যে হুমকি থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা আরও বলেছে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করতে সক্রিয়।


এই ধরনের বক্তব্যের বড় ঝুঁকি হলো—এগুলো খুব দ্রুতই সমাজে একটি প্রাইমারি সাসপেক্ট স্থির করে দিতে পারে। তখন তদন্তকারীদের ওপরও চাপ তৈরি হয়; জনপ্রিয় ধারণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তারা সাক্ষ্য, আলামত, মোবাইল ডাটা, সিসিটিভি ফুটেজ, ব্যালিস্টিক রিপোর্ট, মোটিভ অ্যানালাইসিস—সবকিছু নিরপেক্ষভাবে অনুসরণ করার বদলে একটি আগেভাগে প্রস্তুত সিদ্ধান্তের দিকেই এগোতে পারে।


একবার কোনো ন্যারেটিভ জনপ্রিয় হয়ে গেলে সত্য ভিন্ন হলেও প্রশাসনের তেমন কিছু করার থাকে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই কথাটি অস্বস্তিকর হলেও সত্য।


গণসংহতি আন্দোলন তুলনামূলকভাবে ‘জবাবদিহি’কে সামনে এনেছে। তারা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে বলেছে তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন নিরাপত্তা জোরদার হওয়ার কথা, তখন এমন ঘটনা কীভাবে সম্ভব হলো, সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে জবাব দিতে হবে। এই ফ্রেমিংয়ের মূল্য আছে, কারণ এখানে কারা করেছে প্রশ্নের পাশাপাশি কীভাবে করতে পারল প্রশ্নটি আসে। রাজনৈতিক সহিংসতায় আমরা প্রায়ই অপরাধীর নাম নিয়ে আটকে যাই, কিন্তু যে নিরাপত্তা-পরিবেশ, যে প্রশাসনিক শিথিলতা, যে রাজনৈতিক প্রশ্রয়, যে গোয়েন্দা ব্যর্থতা অপরাধকে সম্ভব করে, সেগুলোই পুনরাবৃত্তির শর্ত তৈরি করে। তাই জবাবদিহির ফ্রেমিং সত্য অনুসন্ধানে সাহায্য করতে পারে, যদি তা দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কাঠামোগত প্রশ্ন হিসেবে টিকে থাকে।


আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। সংবাদমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাদি এর আগে নভেম্বর মাসে ‘হত্যার হুমকি’ পাওয়ার কথা লিখেছিলেন, এমনকি ৩০টিরও বেশি বিদেশি নম্বর থেকে হুমকির কথাও উল্লেখ আছে। নির্বাচনি সহিংসতায় পূর্বহুমকি একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু, কিন্তু এটিও আবার ন্যারেটিভ তৈরির কাঁচামাল হয়ে যায়। এক পক্ষ বলবে, দেখুন প্রশাসন কিছু করেনি, আরেক পক্ষ বলবে, দেখুন এটি সাজানো নাটক, তৃতীয় পক্ষ বলবে, দেখুন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বাস্তবে পূর্বহুমকি মানে হলো তদন্তের জন্য কিছু নির্দিষ্ট কাজ জরুরি, হুমকির উৎস যাচাই, নম্বরগুলোর ট্রেস করা, কল-ডিটেইলস, ডিজিটাল ফরেনসিক, হাদির নিরাপত্তা আবেদন বা জিডি ছিল কি না, এসবের ডকুমেন্টেশন। এগুলো আলোচনায় কম আসে, কারণ এগুলো শিরোনাম বানাতে পারে না, উপরন্তু সত্যের দিকে এগোলে আলোচনা-ট্রিগার করা পক্ষগুলোর জন্য লাভের কিছু নয়।


এই জায়গায় আমি যে বিষয়টিকে সবচেয়ে ভয়ংকর বলে মনে করি, তা হলো দ্রুত রায় দিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি। ঘটনার দিনই আমরা রায় দিয়ে ফেলি, কে দোষী, কে সুবিধাভোগী, কে নায়ক, কে খলনায়ক। এই দ্রুত রায় তিনটি বড় ক্ষতি করে। প্রথমত, প্রকৃত অপরাধী সময় পায়, কারণ জনমত অন্যদিকে ব্যস্ত থাকে। দ্বিতীয়ত, তদন্ত রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, আলামত-ভিত্তিক নয়। তৃতীয়ত, পরবর্তী সহিংসতার জন্য সামাজিক অনুমোদন তৈরি হয়, কারণ মানুষ ভাবে এগুলো অনিবার্য, এগুলো রাজনীতির অংশ। এই তিনটি ক্ষতিই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, আর সহিংসতাবাদীদের শক্তিশালী করে।


বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার পরে ন্যারেটিভ যেভাবে কাজ করে, তার একটি পরিচিত কৌশল হলো ‘মিররিং’, অর্থাৎ এক পক্ষ যা বলে, অন্য পক্ষ একই কাঠামোতে পাল্টা কথা বসিয়ে দেয়। এক পক্ষ বলে নির্বাচন বানচাল, অন্য পক্ষ বলে ক্ষমতা টিকাতে নাটক। এক পক্ষ বলে নিষিদ্ধ দলের অবশিষ্ট সন্ত্রাস, অন্য পক্ষ বলে বিরোধীদের প্ররোচনা। এক পক্ষ বলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অন্য পক্ষ বলে দেশীয় অপশক্তি। এই মিররিংয়ের ফলে সত্য একটি মতামত হয়ে যায়। যখন সত্য মতামতে পরিণত হয়, তখন সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষের মতামতই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।


তাহলে সচেতন নাগরিক কী করবেন? প্রথম কাজ, আবেগকে অস্বীকার নয়, কিন্তু আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়া। একজন প্রার্থীর ওপর প্রকাশ্যে গুলি মানেই নাগরিক নিরাপত্তার ওপর আঘাত, এটিতে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু কারা করেছে, কেন করেছে, সেটা নিশ্চিত না হয়ে নিশ্চিত ভাষায় কথা বলা বন্ধ করা দরকার। দ্বিতীয় কাজ, দ্রুত বিচার নয়, দ্রুত স্বচ্ছতা দাবি করা। তদন্তের টাইমলাইন, কী আলামত সংগ্রহ হলো, সিসিটিভি কোত্থেকে থেকে নেওয়া হলো, ব্যালিস্টিক রিপোর্ট কখন হবে, সাক্ষীদের নিরাপত্তা কীভাবে হবে, এসব প্রশ্ন নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, আইনজীবী সমিতি, মানবাধিকার সংগঠনকে ধারাবাহিকভাবে তুলতে হবে। তৃতীয় কাজ, প্রতিটি দলকে একই মানদণ্ডে বাঁধা। যে দল আজ স্বচ্ছ তদন্ত চাইবে, কাল অন্য ঘটনার বেলায় একই দাবি তুলতে হবে। যে দল আজ সন্ত্রাস বন্ধ করতে বলবে, তার নিজ দলের সহিংস ক্যাডার বা অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে হবে। নইলে নীতিগত কথা শুধু বক্তৃতা হয়ে থাকবে। চতুর্থ কাজ, ন্যারেটিভকে ভাঙতে কে দোষী, এই বাক্য দিয়ে আলোচনা না শুরু করে আলোচনা শুরু করা যায় এইভাবে যে, কোন প্রমাণে কাকে দোষী বলা হচ্ছে, এই বক্তব্যের উৎস কী, এই দাবি কি আদালতে টিকবে, অথবা এই রিপোর্ট কি যাচাই হয়েছে। এটি বিরক্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই জনপরিসরকে স্বাস্থ্যকর বানাতে একমাত্র উপায়। পঞ্চম কাজ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা। তাদেরকে দলীয় প্রচারণার প্রতীক বানানো হলে সহিংসতাও প্রতীকে পরিণত হয়, আর প্রতীকে পরিণত হলে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি সহজ হয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও