সরকারের ১৪ মাস ও অর্থনীতির ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ গল্প
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ১৪ মাস পার করল। সরকারের প্রতিশ্রুতি যদি ঠিক থাকে তাহলে তারা আর পাঁচ মাস ক্ষমতায় থেকে ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে। এ ১৪ মাসে সরকার অর্থনীতিতে কী পরিবর্তন এনেছে তার সংক্ষিপ্ত আলোকপাত শুরু করতে চাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রধানের একটি ফোনালাপ থেকে। গত ১৬ সেপ্টেম্বরের সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ফোন করে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জন্য এক ‘রিমার্কেবল ইকোনমিক টার্নঅ্যারাউন্ড’ আনতে পেরেছে। তিনি বাংলাদেশের দুঃসময়ে ড. ইউনূসের ক্ষমতাগ্রহণকে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাকে বলেছেন ‘দ্য রাইট পারসন অ্যাট দ্য টাইম’। জর্জিয়েভা গত ১৪ মাসের অর্জনে নাকি ‘অভিভূত’।
এসব কথা এসেছে সরকারের প্রেস বিভাগ থেকে যে দপ্তরের আত্মস্তুতিমূলক অত্যুৎসাহী মন্তব্য শুনে আমরা অভ্যস্ত। তাদের অনেক দাবিরই সত্যতা পাওয়া কঠিন। এর কোনটি সত্য আর কোনটি বানানো তা বোঝা মুশকিল। জর্জিয়েভা ইউনূস সরকারের অর্থনৈতিক অর্জনে যদি ‘অভিভূত’ হয়েই থাকেন সেটি তার ব্যক্তিগত বোধ। কিন্তু এ সরকার ১৪ মাসে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ‘মোড় ঘোরানো’ দেখাতে পেরেছে এমন দাবি শুধু অসত্যই নয় বরং অর্থনীতিশাস্ত্রের প্রতি অবিচার। আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ দিত না। কিন্তু উন্নয়নের বয়ানে মন্ত্রীরা ও সাঙ্গোপাঙ্গরা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অনেক সময় তারা উন্নয়নের বয়ানকে খাঁটি বানানোর চেষ্টায় দুই-একটি আন্তর্জাতিক সনদ নিয়ে আসতেন।
বর্তমান সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা আরো উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন না করে জাতিসংঘের মহাসচিব কী বললেন কিংবা আইএমএফের পরিচালক কী বন্দনায় মাতলেন সেটিই যেন মুখ্য সনদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক সময় বড় সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের প্রশংসা অনেকটা সৌজন্যমূলক যা রাজনীতিকরা আত্মজাহিরে ব্যবহার করে থাকেন। আইএমএফ কর্তার প্রশংসার মধ্যেও এ রকম কিছু ঘটলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ অর্থনীতির সূচকগুলো ‘মোড় ঘোরানোর’ কথা বলে না। বরং এগুলো আরো ঝুঁকি ও শঙ্কার কথাই তুলে ধরছে।
‘সংস্কার-নাটক’ নিয়ে অনেক অর্থনীতিবিদের মোহভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে তারা কিছু বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। কারণ তাদের একটা বড় অংশ তড়িঘড়ি করে অত্যুৎসাহে ‘শ্বেতপত্র কমিটিতে’ যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অর্থনীতি কেন ঘুরে দাঁড়ায়নি তার সহজ উত্তর পাওয়া যায় কিন্সের আয় সমীকরণ থেকে। জাতীয় আয় সমীকরণের মূল উপাদান ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় ও বহিঃখাত। গত সরকারের পর বহিঃখাত তথা আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের উন্নতি ঘটেছে যার মূল অবদান বাজারভিত্তিক বিনিময় হার। সেজন্য আইএমএফের প্রশংসা অবশ্যি প্রাপ্য, কারণ এটি তাদের শর্তও ছিল। কিন্তু মানুষের ভোগ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এবং সরকারের ব্যয় এ তিন বড় খাতের কোথাও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। রয়েছে দৃশ্যমান অবনতি।
দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত ভোগ কমিয়ে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা ক্রয়ক্ষমতার উন্নয়নে অকার্যকর। মূল্যস্ফীতির দৌড়ের সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির হার পেরে উঠছে না। ফলে প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। ২০২৪-এর আগস্টে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ১০ ভাগ। ২০২৫-এর আগস্টে তা ৯ দশমিক ৬ ভাগ যা কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তুলে ধরে না। তবে বিন্দু-থেকে-বিন্দু পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি শতকরা ১০ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৩ ভাগে নেমেছে, অর্থাৎ নামার এক প্রবণতা দেখাচ্ছে। এটি যথেষ্ট নয়, বিশেষত এই সময়ে যখন বৈশ্বিক তেল ও পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০২২-এর জুনে বৈশ্বিক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১৯ ডলারে উঠেছিল। এ দাম ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরের শেষে ৬২ ডলারের নেমেছে। বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের সূচক ২০২২ সালে ২৩০-এ উঠেছিল, যা আজ ১৬৪-তে নেমেছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ মুদ্রানীতি বা রাজস্বনীতির কোনো দক্ষতা প্রমাণ করে না। মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার বিচারে এ সরকার প্রতিবেশী সবার থেকে পিছিয়ে আছে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা—প্রত্যেকেই কভিড-পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগে প্রবেশ করেছিল। ভারত ২০২২ সালে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ প্রায় ৭ ভাগ থেকে মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে। ২০২৫-এর আগস্টে তা শতকরা ২ দশমিক ১ ভাগে নেমেছে। ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ শতকরা ৩১ ভাগে পৌঁছে যায়। তারা সেটিকে শতকরা মাত্র ৩ ভাগে নামিয়েছে এ আগস্টে। ২০২২ সালে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি রেকর্ড শতকরা ৫০ ভাগে উঠে যায়। সেটিকে তারা ২০২৪-এ ডিফ্লেশন বা ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতিতে নামিয়েছিল। ২০২৫-এর আগস্টে তা মাত্র শতকরা দেড় ভাগে উঠেছে।
অথচ বাংলাদেশে দ্বিসংখ্যক মূল্যস্ফীতি গত সাড়ে তিন বছর প্রায় এক জায়গায় বসে আছে। ইউনূস সরকারের গত ১৪ মাসেও এর কোনো উল্লেখযোগ্য পতন নিশ্চিত করা যায়নি। এতেও যদি আইএমএফ কর্তা ‘অভিভূত’ হয়ে পড়েন তাহলে সেটি তার নরম মনের পরিচায়ক অথবা প্রেস বিভাগের আত্মস্তুতিমূলক সনদ বানানোর অকাতর সৃজনশীলতা।
ভোগ অর্থনীতির প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ দখল করে থাকে। সেখানে ঘাটতি হলে কিংবা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি সাধিত না হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যায়। ঘটেছেও তাই। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি একমাত্র কভিডের বছর বাদ দিলে তিন দশকে সর্বনিম্ন, যা সরকারের হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শতকরা ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ। যদিও বিশ্বব্যাংকের মতে এটি সাড়ে তিন ভাগের নিচে। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি শতকরা ২৫ নেমে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এ-জাতীয় আমদানি কমে আসাও সাম্প্রতিক রিজার্ভ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
একাধিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় মানুষ সঞ্চয় ভাঙিয়ে খাচ্ছে। উচ্চ সুদের কারণে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বৃদ্ধি যেখানে বছর বছর বাড়ে সেখানে ২০২৫ অর্থবছরে এর নিট বিক্রি ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা কমে গেছে। এটি চলমান ভোগ সংকটের চিত্র তুলে ধরে। সঞ্চয় বিনিয়োগের সহায়ক। বিনিয়োগেও চলছে মন্দাভাব, যার কোনো উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। ব্যক্তি বিনিয়োগ বছর বছর বাড়বে এটিই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বর্তমান সরকার স্থিতিশীল হলে বিনিয়োগ বাড়ত। কিন্তু তা ঘটেনি। বর্তমান সরকারপ্রধান ব্যক্তি উদ্যোগের এক দৃষ্টান্ত হলেও প্রায় সব উদ্যোক্তা এখন অপেক্ষায় রয়েছেন কবে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। সামাজিক নিরাপত্তাবোধ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত বলে ব্যক্তি উদ্যোগ থমকে রয়েছে। বিএনপির একজন ব্যারিস্টার নারী নেত্রী মন্তব্য করেছেন, যে দেশে ৩৬৫ দিনে ৩৭০টি মব সন্ত্রাস ঘটে সে দেশে পাগলও বিনিয়োগ করবে না।