মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের চার বছরে ৪০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করতে চান। গত বছর তার নির্বাচনি অভিযানে তিনি আমেরিকাকে অবৈধ অভিবাসীমুক্ত করার যে সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, তার সেই অভিযান নতুন মোড় নিয়েছে। নিউইয়র্ক সিটিসহ ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ন্ত্রিত বড় বড় যেসব সিটিকে ‘স্যাঙ্কচ্যুয়ারি সিটি’ বা অভিবাসীদের জন্য ‘অভয়ারণ্য’ বিবেচনা করা হতো, সেই সিটিগুলোতে অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড়ের ঘটনা অতীতের যে কোনো অভিবাসীবিরোধী অভিযানের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ (আইস) এজেন্টরা গত কয়েকদিন ধরে চায়না টাউনখ্যাত ক্যানাল স্ট্রিট এবং সিটির আরও কয়েকটি স্থানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বহু কৃষ্ণাঙ্গসহ অন্তত দুই শতাধিক অবৈধ অভিবাসীকে আটক করায় অবৈধ অভিবাসীরা ছাড়াও বৈধ অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মুখপাত্র বলেছেন, আটকদের মধ্যে কয়েকটি আফ্রিকান দেশের নয়জন অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ে আটক করার পরও তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং হোমল্যান্ড নোয়েমের অধীনে অপরাধ ঘটিয়ে কোনো অবৈধ অভিবাসী পার পেতে পারে না।
‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬ লাখ অবৈধ অভিবাসী আটক ও বহিষ্কারের টার্গেট স্থির করেছিল, যাদের মধ্যে আনুমানিক ২ লাখকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। তাদের মতে, এটা কেবল শুরু হয়েছে। প্রশাসনের হাতে আরও তিন বছরের বেশি সময় রয়েছে, যে সময়ের মধ্যে টার্গেট পূরণ করা সম্ভব। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘দ্য পোস্ট’-এর এক রিপোর্টের নতুন এক তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করার মধ্য দিয়ে প্রশাসন আশা করছে, সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হলে এ বছরের মধ্যে ৬ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়ন করা আদৌ অসম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন ফেডারেল আর্থিক বরাদ্দ। ডিটেনশন সেন্টারে অভিবাসীদের দীর্ঘদিন আটক রাখা ব্যয়বহুল ব্যাপার এবং আটক করার পর অবিলম্বে অবৈধদের বিমানযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করাও ব্যয়বহুল। কাজেই হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ অভিবাসী বিতাড়ন টার্গেট পূরণ করার জন্য যে অর্থ দাবি করেছে, প্রেসিডেন্ট তা নির্বাহী ক্ষমতায় থোক বরাদ্দ হিসাবে দিলেও কংগ্রেসের অনুমোদন লাভে নিশ্চিত বাধাপ্রাপ্ত হবে। তবে অধিকাংশ কংগ্রেসম্যান দেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নের পক্ষে। অতএব এ খাতে বরাদ্দের অনুমোদন খুব কঠিন হবে না।
তবে অবৈধ অভিবাসীদের গণহারে বহিষ্কারের প্রভাবে বহু অবৈধ অভিবাসী স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে গেছে; হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মতে, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ২০ লাখেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছে। আইস এজেন্ট এবং অন্যান্য ফেডারেল ইমিগ্রেশন প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (ডিএইচএস) মুখপাত্র ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিনের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোয়েম যে বিপুল উদ্যমে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন শুরু করেছেন, এর পূর্ববতী চার বছর, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদে অভিবাসন এজেন্সিগুলো এত গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নের উদ্যোগ নেয়নি। একথা সত্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসন ইস্যুতে অত্যন্ত কট্টর, যা তার আগে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে যেসব রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে এসেছেন, তাদের কারও গৃহীত অভিবাসন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে অভিবাসন ইস্যুতে তিনি যে কেবল ডেমোক্রেটদের কাছেই অপ্রিয় তা নয়, অনেক রিপাবলিকানের কাছেও ট্রাম্প অপ্রিয়। রিপাবলিকানদের একটি অংশ বরং অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় নিয়ে আসার পক্ষে। ডেমোক্রেটরা ঐতিহ্যগতভাবে অভিবাসীবান্ধব। কিন্তু তারাও যখন প্রশাসনে থাকে, তখন অবৈধ অভিবাসীদের ডিপোর্ট করতে কোনো ছাড় দেয় না। গত তিন দশকের মধ্যে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দুই মেয়াদে সর্বাধিকসংখ্যক অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যে কারণে অভিবাসন প্রবক্তারা তাকে বলতেন ‘ডিপোর্টার-ইন-চিফ’।
ফেডারেল অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মতে, অবৈধ অভিবাসীদের কবল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্ত করতে তাদের আটক ও ডিপোর্ট করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ঐতিহাসিক অগ্রগতি সাধন করেছেন। ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী নীতি বাস্তবায়নের প্রতিটি পদক্ষেপ আটকে গেছে ফেডারেল বিচারকদের জারি করা স্থগিতাদেশের কারণে। কিন্তু ট্রাম্প তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে পিছু হটেননি। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আরও বলছে, অবৈধ অভিবাসীরা যদি স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ নিজ দেশে চলে যেতে আগ্রহী হয়, তাহলে তাদের বিমান ভাড়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যয়ের সংস্থান করা হবে। তাতে কিছু অভিবাসী সাড়া দিলেও ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়নি। অতএব ট্রাম্প প্রশাসনে অভিবাসীবিরোধী কর্মসূচি এত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে যে, অভিবাসীদের বহিষ্কারের দায়িত্বে নিয়োজিতরা অবৈধদের সঙ্গে অনেক বৈধ অভিবাসীকেও আটক ও ডিপোর্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বৈধভাবে অবস্থানের কোনো প্রমাণই তারা গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এতটাই উগ্রতার পরিচয় দিচ্ছে যে, তারা আইন লঙ্ঘনকারী ও অপরাধে জড়িত অভিবাসীদের অনিবার্য পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার ভীতি প্রদর্শন করছে। এতে আমেরিকার একটি উপকার হচ্ছে, মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের হার জো বাইডেনের আমলের চেয়ে শুধু যে হ্রাস পেয়েছে তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করলে যে আবারও নিশ্চিতভাবে তাদের সীমান্তের মেক্সিকো অংশে ফেরত পাঠানো হবে, তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে তারা অনুপ্রবেশ করার আগেই পিছু হটছে। আমেরিকান কর্তৃপক্ষ এটিকে তাদের অভিবাসন নীতির সাফল্য হিসাবে বর্ণনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন সাফল্য অর্জনের কৃতিত্ব দাবি করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের শেষ বছর ২০২৪ সালে ২ লাখ ৭১ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। এর আগের বছর ২০২৩ সালে বহিষ্কার করা হয়েছিল আরও কমসংখ্যক অভিবাসীকে; মাত্র ১ লাখ ৪২ হাজার জনকে। ট্রাম্পের অধীনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা করেছে, তারা গত চার মাস ধরে কোনো বিদেশিকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের অভিবাসন নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য যোগ করেছে : ‘উন্মুক্ত সীমান্তের যুগ শেষ হয়ে গেছে।’ লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো এবং ওরিগনের পোর্টল্যান্ডের মতো স্যাঙ্কচ্যুয়ারি সিটিগুলোতে অবৈধ অভিবাসীদের আটক ও বহিষ্কার বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিছু বাধা আসছে মাদক পাচারকারী ও গ্যাং সদস্যদের পক্ষ থেকে। তারা বিভিন্ন সময়ে অভিবাসন আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। অবৈধ অভিবাসীদের পক্ষে দাঙ্গাবাজরাও ‘আইস’ এজেন্টদের হামলার টার্গেটে পরিণত করছে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে। ২০২৫ সালে ‘আইস’ এজেন্টদের ওপর হামলার ঘটনা ১০০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে টেক্সাসে তিনটি চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনাও আছে। ডালাসের একটি ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে এক ব্যক্তি ‘আইস’ এজেন্টদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে এজেন্টদের গায়ে না লেগে দুজন আটক অভিবাসী নিহত হন। তারা ডিপোর্টেড হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলেন।