জুলাই সনদ কি টেকসই হবে
বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদে এ পর্যন্ত সই দিয়েছে ২৫টি রাজনৈতিক দল। সনদে উল্লেখিত প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে। সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষ আদেশের খসড়া তৈরি করেছে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। হয়তো আজকালের মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে কমিটির সুপারিশ জমা দেবে ঐকমত্য কমিশন।
সনদের খসড়া তৈরির কাজ যখন চলছিল, কীভাবে এর বাস্তবায়ন হবে, তখন এটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের আওতায় ছিল না। তখনই এ নিয়ে কথাবার্তা হতে থাকে। প্রশ্ন উঠেছিল, এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলে এটি কেবল কাগুজে দলিল হয়েই থাকবে।
৩১ জুলাইয়ের পর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এ আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়।
যতটুকু জানা গেছে, সনদ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে একটি বিশেষ আদেশ জারি করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে ওই আদেশের ওপর অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। ভবিষ্যতে যে সংসদ হবে, তার দ্বৈত ভূমিকা থাকবে। একটি ভূমিকা হলো সংবিধানের দরকারি সংশোধনগুলো করা। অন্যটি হলো নিয়মিত সংসদ হিসেবে পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া।
জানা গেছে, প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী এ আদেশের নাম হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’। এটি সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপূরক হবে। এ আদেশের ভিত্তি হবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। অর্থাৎ ‘গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আদেশ জারি করা হবে’। আদেশের পরিশিষ্টে থাকবে জুলাই জাতীয় সনদ। এ আদেশের ওপর হবে গণভোট। যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটাও এখানে উল্লেখ থাকতে পারে (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০২৫)।
এ আদেশ জারি নিয়েও আছে মতভেদ। বিএনপি একটি বড় দল। দলটি এ ধরনের বিশেষ আদেশ জারি সমর্থন করে না। আবার কয়েকটি দল, যেমন জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি, এ রকম একটি আদেশ জারির দাবি জানিয়ে আসছে।
আদেশ জারি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু না বলায় এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। শুধু বর্জন নয়, তারা একটি সমাবেশ ঘটিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা দিয়েছিল। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমবেত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে। জনমনে ধারণা, এনসিপি এটি ঘটিয়েছে, যদিও দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ ওই সমাবেশে ছিলেন না। ফলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন হয়েছে। এত সময় ও শ্রম দিয়ে এ আয়োজনের ব্যবস্থা হলেও তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।
জুলাই সনদে বর্ণিত অঙ্গীকারনামা শেষ মুহূর্তে এসে পরিমার্জন করা হয়েছে, যেটি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। ঐকমত্য কমিশন এ বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে বলেই শেষ মুহূর্তে এসে কিছু অঙ্গীকারের কথা সংযোজন করেছে। প্রশ্ন হলো, কমিশন এটি আগে কেন বিবেচনায় নেয়নি? এ নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, এটুকু বোঝার মতো কেউ কি কমিশনে ছিলেন না? নাকি কোনো বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে প্রবোধ দিতে তাঁরা শেষ সময়ে এসে দু-চার কথা লিখেছেন? তার মানে কি এই যে কমিশন স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে পারে না? চাপ দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়?