যৌন হয়রানি এবং ‘আমরা-তারা’ রাজনীতি

বিডি নিউজ ২৪ জোবাইদা নাসরীন প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই দুই দিনে বেশ খানিকটা জায়গা দখল করেছে একজন সংবাদমাধ্যকর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যা এবং তার সঙ্গে আলোচনায়-সমালোচনায় আছেন একজন সাংবাদিক আলতাফ শাহনেওয়াজ। তার বিরুদ্ধে উঠেছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং পরে মূলধারার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তার কর্মস্থল ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ইফতেখার মাহমুদের কাছে তিন মাস আগেই যৌন হয়রানি, বাজে আচরণসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন ওই হাউজের কয়েকজন কর্মী। তাদের অন্যতম আত্মহত্যা করা এই নারী।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড়ের পর থেকে যে কয়েকটি বিষয় নজরে এসেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আমরা’ ও ‘তারা’র রাজনীতি। তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, শুধু এবারই নয়—এর আগেও দেখা গেছে, এই ধরনের বিষয়ে এক ধরনের পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা থাকে। সে প্রবণতা সব সময়ই যে পুরুষতান্ত্রিক দেনদরবারের নিক্তিতে ঘোরে, তা নয়; কখনও ‘আমার বন্ধু’, ‘আমি অনেক দিন থেকে চিনি’, ‘আমি বিশ্বাস করি না’, ‘সে এ ধরনের কাজ করতে পারে না’ কিংবা ‘আদালতের রায়ই চূড়ান্ত রায়’—এই ধরনের বক্তব্য আসে, কারণ অভিযুক্ত হয়তো কোনো বিশেষ ঘরানার। কিন্তু আবার শত্রু ঘরানার হলেই ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ অবস্থা। যুক্তি আসে, ‘আদালত তো নিরপেক্ষ নয়—তাই জনগণের আদালতেই বিচার করতে হবে’ জাতীয় কথাবার্তা।


তবে দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, পরিবার—এসবের দোহাই দিয়ে যৌন হয়রানি বিষয়ে ‘সমঝোতা’, ‘মিটমাট’ কিংবা ‘চাপা দেওয়ার’ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি জারি রয়েছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌন নিপীড়নের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আর কোথাও যৌন হয়রানি ঘটে না। খোদ সচিবালয় থেকে শুরু করে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই এখন পর্যন্ত যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল গঠিত হয়নি।


আরেকটু ছোট্ট নোক্তা দিয়ে রাখছি এই বলে যে, মিডিয়াতে যৌন হয়রানির অভিযোগ যে এটাই প্রথম, এমন নয়। এর আগেও আমি আমার দু’চারজন নারী সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা শুনেছি। এরও পরে হ্যাশট্যাগ ‘#মিটু’ শুরু হলে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন।


তবে আলতাফের ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর দু’একজন সাবেক নারী সাংবাদিক তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এবং কীভাবে সেগুলো সম্পাদক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি, সেই বিষয়েও লিখেছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, সম্পাদক অবহিত হলেও সেই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।


খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হল—সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় যৌন হয়রানি নিয়ে খবর পরিবেশনে যতটা আগ্রহী, ঠিক ততটাই নীরব নিজেদের ঘরে ঘটে যাওয়া এই বিষয়ে আলাপ পাড়তে। আমি জানি না, কয়টি মিডিয়া হাউজ হাই কোর্টের নির্দেশনার আলোকে তাদের প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল গঠন করেছে।


হাই কোর্টের মূল নির্দেশনাগুলো হল সরকারি, বেসরকারি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল কর্মক্ষেত্রে একটি করে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি গঠন করতে হবে। প্রতিটি কমিটিতে কমপক্ষে ৫ জন সদস্য থাকবেন এবং সদস্যদের বেশিরভাগই নারী হবেন। এই কমিটি যৌন হয়রানির অভিযোগ গ্রহণ, ঘটনার তদন্ত এবং উপযুক্ত সুপারিশ করবে। হাই কোর্টের এই নির্দেশনাটি আইন হিসেবে কার্যকর এবং এটি সব প্রতিষ্ঠানে পালনের জন্য বাধ্যতামূলক।


আমি নিশ্চিত, মিডিয়া হাউজগুলো থেকে এই বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যাবে না; কারণ নিজেদের তথ্য ধামাচাপা দিতে হয়, বের করতে হয় অন্যের তথ্য এই নিয়মে চলে আমাদের সংবাদমাধ্যম। এবার অবশ্য অনেক তথ্যই গলগল করে বের হয়ে এসেছে।


এই মৃত্যু এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ বিষয়ে সেই নারীর কর্মক্ষেত্র, অর্থাৎ ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষের অবস্থান কী? এই বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে— ‘শনিবার সন্ধ্যায় স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের অকাল মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ঢাকা স্ট্রিম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। পুলিশ ইতোমধ্যে মরদেহের ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা সামগ্রিক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করছি। ঢাকা স্ট্রিম এক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।’


ঢাকা স্ট্রিম জানায়, স্বর্ণময়ী বিশ্বাস প্রতিষ্ঠানটির গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন। কর্মপরিবেশে তিনি অত্যন্ত আন্তরিক; সহকর্মী হিসেবে ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন। দক্ষতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজন সহকর্মীকে হারিয়ে আমরা শোকে মুহ্যমান। তবে স্বর্ণময়ীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে।


বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে—‘ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ১৩ জুলাই মানবসম্পদ বিভাগে একটি অভিযোগপত্র জমা পড়ে। অভিযোগ পাওয়ার পর আলতাফ শাহনেওয়াজকে তাৎক্ষণিকভাবে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সহকর্মীদের সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে, ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ তাঁর বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে এবং কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের আচরণবিধি চূড়ান্ত করে।’


বিজ্ঞপ্তিতে আরও দাবি করা হয় যে, কর্তৃপক্ষের এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অভিযোগকারীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আরও বলা হয়েছে, ঢাকা স্ট্রিমের পক্ষ থেকে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে সব সহকর্মীকে অবহিত করা হয় এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।


বিজ্ঞপ্তির আরেকটি অংশ খুব গুরুত্বপূর্ণ—সেখানে বলা হয়েছে, স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিন মাস আগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা প্রয়াত সহকর্মী স্বর্ণময়ীর পরিবারের সঙ্গে আছি। পরিবারের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবার প্রতি সংবেদনশীল আচরণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। ঢাকা স্ট্রিম পরিবার যেকোনো ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিল এবং থাকবে। কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান সচেতন ও অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও