
হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা...
হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা,
আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।
যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি। থাকি চাচা-চাচীর কাছে।
দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান—ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো। অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড—বইয়ের পোকা।
একই ক্লাসে পড়ি আমরা।
পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরানো এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।
নতুন আরেকটা রহস্যের সমাধান করতে চলেছি।
এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।
আজও যারা এই তিন গোয়েন্দার পরিচয় জানে না, তাদের জন্য বলছি, ওপরের কথাগুলো আসলে কিশোর পাশার নয়, রকিব হাসানের। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা তিনি। কিশোর, মুসা আর রবিন চরিত্র দিয়ে যিনি অসংখ্য রহস্যের সমাধান করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন সত্যিকারের কিশোর-কিশোরীদের, যারা একটা সময় তিন গোয়েন্দায় মজে থাকতাম দিনরাত। ভাষার মাধুর্য, জানার প্রবল আগ্রহ, প্রশ্ন করার সাহস ও উত্তর খোঁজার তাড়া তো তিনিই শিখিয়েছেন। কত যে কিশোর মন লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বিচ থেকে ঘুরে এসেছে, তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কেউ ভাগ্যবান, সত্যিই ঘুরতে গিয়েছেন রকি বিচে। কল্পনার জগৎকে রোমাঞ্চে ভরিয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা। এসব তো সম্ভব হয়েছে রকিব হাসানের কারণেই। তা কি অস্বীকার করা যায়?
রকিব হাসান পৃথিবীর সব মোহমায়া ত্যাগ করেছেন ১৫ অক্টোবর। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি পাঠক হৃদয়ে প্রাণোচ্ছল থাকবে আজীবন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা, সেই ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি কিশোর, মুসা, রবিনের জনপ্রিয়তা জিইয়ে রেখেছেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে। শুধু তা-ই না, আমরা যখন স্কুলের বইয়ের ভেতর লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তাম, তখন ধরা পড়ে গেলে অভিভাবকেরা বই কেড়ে নিতেন, আর নিজেরাই এর পাঠক-ভক্ত হয়ে যেতেন।
রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজ আর এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’-এর ছায়া অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার বেশ কিছু গল্প লিখেছেন রকিব হাসান। কিন্তু তাতে সিরিজটির জৌলুশ একটুও কমেনি। পাঠক এতটাই তিন গোয়েন্দার নেশায় বিভোর হয়ে যায়! বিষয়টা তিন বেলা ক্ষুধা লাগার মতো, যাঁরা এই সিরিজের পাঠক-ভক্ত তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন।
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মেছিলেন তিন গোয়েন্দার জনক। সনদে তাঁর নাম কিন্তু আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব। বাবা ডাকতেন হাসান নামে। আর পাঠকের কাছে তিনি রকিব হাসান। সত্তরের দশকে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনুবাদ দিয়ে শুরু করেন লেখালেখি। প্রথমে ছদ্মনামে লিখতেন। ১৯৭৭ সালে ‘ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা’ অনুবাদ করে স্বনামে প্রকাশ করেন প্রথম বই। ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ কিংবা ‘টারজান’-এর অনুবাদ—বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বইয়ে নিজের সেরাটাই ঢেলে দিয়েছেন তিনি। কিশোরদের জন্য কিছু ভৌতিক গল্প ও সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন মন খুলে। তবে তাঁর সব লেখাকেই ছাপিয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।
আর এই তিন গোয়েন্দা যে আমাদের কিশোর বয়সে কেমন প্রভাব ফেলেছিল, তার ছোট একটা উদাহরণ বলি। এলাকায় আমরা তিন বন্ধু ছিলাম, অভিন্ন স্কুল এবং ভিন্ন ক্লাসেই পড়তাম। তিনজনই বুঁদ হয়ে পড়তাম তিন গোয়েন্দা। এই সুবাদে তিনজনের বন্ধুত্ব বেশ পাকাপোক্ত হয়। একবার আমরা ঠিক করলাম কিশোর-মুসা-রবিনের মতো একটা গোয়েন্দা সংস্থা খোলার। শিমলা আপু বইয়ের পোকা হওয়ায় তাঁকে আমরা রবিন মিলফোর্ড নাম দিলাম। খুশির চুল কোঁকড়া বলে সে হলো কিশোর পাশা। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি হয়ে গেলাম মুসা আমান। অবশ্যই সবাই তিন গোয়েন্দার লেডি ভার্সন! শিমলা আপুর খালাতো বোন কলি আপু বেজায় সুন্দরী হওয়ায় তিনি হলেন জর্জিনা পার্কার ওরফে জিনা। দুষ্টু কাকে যেন শুঁটকি টেরি নামও দিয়েছিলাম, মনে নেই।
খুশিদের বাড়ি টিনশেড ভবন। পেয়ারাগাছ বেয়ে টিনের চালে উঠে গাছের ডাল-পাতার আড়ালে বসে যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম আমরা। সেটাই ছিল আমাদের হেডকোয়ার্টার্স। সেখান থেকে এলাকার দৃশ্য মোটামুটি দেখা যেত এবং আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম কোনো মন্দ কাজ হচ্ছে কি না, তা বের করার। কিন্তু কখনোই কোনো রহস্য পেলাম না ভেদ করার জন্য। বরং কার সঙ্গে কার প্রেম চলে, তারা ইশারায় কীভাবে কথা বলে, এসব দৃশ্যের সাক্ষী হতে থাকলাম! স্কুল শেষ করার পর আমাদের সেই আড্ডা আর হতো না। বড় হয়ে আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ার বেছে নিলাম। কিন্তু কেউ গোয়েন্দা হতে পারিনি। তাতে কী! রকিব হাসান তিন গোয়েন্দার মাধ্যমে আমাদের ভেতর প্রশ্ন করা ও উত্তর খোঁজার ইচ্ছা আর ভাষাশৈলীর যে ব্যবহার শিখিয়ে গেছেন, তা হয়তো আমরাও বুঝতে পারিনি। আর রকিব হাসান তো জানতেই পারলেন না—হয়তো আমাদের মতো আরও অনেক পাঠক নিজেদের কিশোর, মুসা, রবিন কিংবা জিনা ভেবে নিয়েছেন।
রকিব হাসান কি একেবারেই চলে গেছেন? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ওপারে কী হচ্ছে—সেই রহস্য ভেদ করতে গেছেন তিনি। কিশোর মনে যে ব্যক্তি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে গেছেন, তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্মরণ
- রকিব হাসান