
খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি
গতকাল ছিল বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল-‘Hand in Hand for Better Foods and a Better Future’, যার অর্থ হলো ‘সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন সবাই সুস্থ ও পুষ্টিকর খাদ্য পায় এবং উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়। বিষয়টি সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে জড়িত। শুধু খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, খাদ্যের গুণগত মান, পুষ্টি, পরিবেশবান্ধব চাষ এবং ন্যায্য বণ্টনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বিশ্বের প্রতি নয়জনে একজন অপুষ্টির শিকার। এ হিসাবে অপুষ্টির শিকার মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৯ কোটি ৫০ লাখ। এ জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস এশিয়া মহাদেশে। সারাবিশ্বে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করে এমন ৬ কোটি ৬০ লাখ শিশু পেটে ক্ষুধা নিয়ে স্কুলে যায়। আবার বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান আসে কৃষি থেকে। কৃষিতে নারীরা যদি পুরুষের সমানভাবে অংশ নেন, তা হলে বিশ্বে ক্ষুধার্ত লোকের সংখ্যা ১৫ কোটি পর্যন্ত কমতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। শিশু, নারী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতির পরিমাণ বেশি। বিশ্ব খাদ্য দিবস শুধু খাদ্য ও পুষ্টির জন্য নয়, এটি অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং মানুষের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। খাদ্য ঘাটতি শুধু ক্ষুধা নয়, এটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং দেশের অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি শিশু পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ না পায়, তাহলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায় এবং ভবিষ্যতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের মাধ্যমে উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে কৃষি খাত এখনো অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত, আর এ খাতের অবদান মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। দেশের ৯০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের আয় ও জীবিকা কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। দেশের মোট কৃষিজমির প্রায় ৭১ শতাংশ চাষযোগ্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি জমির কৃষকরা কৃষি উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ বর্তমানে ধান উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ, চীন ও ভারতের পরই যার অবস্থান। প্রতিবছর দেশে গড়ে ৩৮ থেকে ৪০ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হয়, যা অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ। একইভাবে সবজি উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে দেশটি। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ও জলবায়ু সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, সার ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের কারণে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০০৮ সালে কৃষিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির হার যেখানে ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে লবণাক্ততা, উত্তরাঞ্চলে খরা ও নদীভাঙন কৃষিতে প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি, বসতবাড়ি ও শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে বছরে গড়ে ১ শতাংশ হারে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বাজার সুবিধা না থাকা, পরিবহণ খরচ, সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা লাভজনক কৃষিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য অপচয় কমানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজার শক্তিশালী করা এবং সরাসরি কৃষক-ভোক্তা তৈরি করার উদ্যোগ জরুরি। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে স্থানীয় উৎপাদনকেন্দ্রিক বাজারব্যবস্থা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
পরিবেশবান্ধব কৃষি অপরিহার্য। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটির উর্বরতা কমায় এবং পানিকে দূষিত করে। জৈব সার, পরিমিত রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও সঠিক সেচ ব্যবস্থাপনা টেকসই কৃষিতে অবদান রাখতে পারে। কৃষি উৎপাদনে পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে ফসল টিকে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো, কৃষিভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা, বিশ্ব কৃষিবাজারে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অহেতুক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা এবং বিশ্ব খাদ্যপণ্যের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন যথার্থতা লাভ করবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারি খাত বাংলাদেশে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়নে সহায়তা করছে। হাতে হাত রেখে একসঙ্গে সবাই কাজ করলে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিকে এককভাবে নয়, সমন্বিত উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে দেখতে হবে। এতে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, এবং বাজারনীতির সমন্বয় অপরিহার্য। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি এবং জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে টেকসই উৎপাদন, ন্যায্যমূল্য, পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব খাদ্য দিবস
- অপুষ্টি
- কৃষি খাত