
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে ডিজিটাল মুদ্রা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও শিল্প খাতে প্রযুক্তির দুর্বলতা এবং এর ফলে উদ্ভূত নিরাপত্তা ঝুঁকি অত্যন্ত প্রকট। অনিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং নিম্নমানের আইটি অবকাঠামো এ চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবার অপরাধীরা সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ২০১৩ সালে সোনালী ব্যাংকের ৪ কোটি টাকা চুরি করেছিল। এর চেয়েও বড় সাইবার আক্রমণ ঘটে ২০১৬ সালে, যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১,২৩২ কোটি টাকা ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি হয়। উন্নত দেশ, যেমন : যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের আধুনিক প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর তুলনায় আমাদের ব্যাংকের আইটি সিস্টেম অত্যন্ত ভঙ্গুর। ফলস্বরূপ সরকারি, বেসরকারি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং শিল্পকারখানার আইটি সিস্টেমগুলো ঘনঘন অকার্যকর হয়ে পড়ছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইটি ব্যবস্থার দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীভূত ব্যাংকিং ব্যবস্থারও বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে। আর্থিক লেনদেনের জন্য আমরা পুরোপুরি ব্যাংক ও সরকারের ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ব্যাংক চাইলেই যে কোনো অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে পারে বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, অ্যাকসেস অস্বীকার করতে পারে বা উত্তোলন সীমা আরোপ করতে পারে। সরকার মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা মুদ্রাস্ফীতির দিকে নিয়ে যায়। এর সঙ্গে অনুন্নত অঞ্চলের মানুষের জন্য ব্যাংকিং পরিষেবাগুলোয় প্রবেশাধিকার সীমিত থাকে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ব্যাংক স্থানান্তর (সুইফট, ওয়্যার ট্রান্সফার) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েকদিন সময় নিতে পারে।
সব দেশেই ফিয়াট মুদ্রা তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যারা সীমাহীন অর্থ মুদ্রণ করতে পারে। এর কারণে আমরা দেখেছি দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দেশগুলো (যেমন: ভেনেজুয়েলা, জিম্বাবুয়ে) অতিমুদ্রাস্ফীতির মুখে পড়েছে, যা অর্থনৈতিকভাবে দেশগুলোকে অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে এবং জনগণ সীমাহীন ভোগান্তির সম্মুখীন হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমগুলো (ক্রেডিট কার্ড, পেপ্যাল) প্রতিটি লেনদেন ট্র্যাক করে, সরকার এবং করপোরেশনগুলো ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যাংকের মতো মধ্যস্থতাকারীদের ওপর নির্ভর করে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত বা অদক্ষ হতে পারে এবং সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো রেকর্ড ম্যানিপুলেট করতে বা আর্থিক লেনদেন লুকাতে পারে। আর্থিক ব্যবস্থা ধীর, ব্যয়বহুল, কেন্দ্রীভূত এবং মুদ্রাস্ফীতি, সেন্সরশিপ ও দুর্নীতির জন্য দুর্বল থাকে।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ব্লকচেইনের মতো উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ ইন্ডাস্ট্রি ৫.০-এর উপযোগী সুযোগ তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রটিতে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক উচ্চমানের নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। আমি মনে করি, আমাদের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আইটি সিস্টেমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন তা অর্থ পাচার রোধ, নিরাপদ আর্থিক লেনদেন নিশ্চিতকরণ, ব্যাংকিং খাতকে হ্যাকারদের হাত থেকে রক্ষা করা এবং দ্রুত, স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী লেনদেনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে; যা সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ থেকে শুরু করে বড় করপোরেশনসহ সব ধরনের ব্যবসার জন্য অপরিহার্য।
ডিজিটাল মুদ্রা এমন অর্থ, যা শুধু ইলেকট্রনিক রূপে বিদ্যমান এবং লেনদেন ও বাণিজ্যের জন্য কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই ব্যবহার করা যায়। এ ব্যবস্থা প্রচলিত নগদ অর্থের বিপরীতে একটি ডিজিটাল লেজার সিস্টেমে সংরক্ষিত হয়, যা দ্রুত ও সুরক্ষিত অর্থ স্থানান্তরকে সম্ভব করে তোলে। ডিজিটাল মুদ্রার প্রধানত তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে : প্রথমত, ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন: বিটকয়েন বা ইথেরিয়াম, যা বিকেন্দ্রীভূত লেজার প্রযুক্তি (সাধারণত ব্লকচেইন) ব্যবহার করে পরিচালিত হয় এবং কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। দ্বিতীয়ত, ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা কোনো নির্দিষ্ট ভার্চুয়াল পরিবেশে (যেমন : গেমিং বা সামাজিক প্ল্যাটফর্মে) ব্যবহার করা হয় এবং তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা, যা একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা সরাসরি জারি ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এটি দেশের ফিয়াট মুদ্রার একটি ডিজিটাল সংস্করণ। এ প্রযুক্তিগত ভিন্নতা সত্ত্বেও সব ডিজিটাল মুদ্রার মূল লক্ষ্য হলো আধুনিক লেনদেনব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও সহজ করে তোলা।
ডিজিটাল মুদ্রা দ্রুত লেনদেনের সময় এবং কম খরচের মতো সুস্পষ্ট সুবিধা দিলেও এটি বেশকিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখে পড়ে। এক্ষেত্রে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি এবং উচ্চমূল্যের অস্থিরতা অন্যতম। এ হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিগুলোর কারণে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা বা সিবিডিসি নিয়ে গবেষণা করছে। সিবিডিসি প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা উন্নত করা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সমাজের বৃহত্তর অংশকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসা। উদাহরণস্বরূপ, সিবিডিসির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সরাসরি ব্যাংকিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে, যা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করবে। ডিজিটাল মুদ্রার ভবিষ্যৎ সম্ভবত স্টেবলকয়েনের মতো উদ্ভাবন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মুদ্রাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। স্টেবলকয়েন এমন ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা ডলার বা সোনার মতো একটি স্থিতিশীল সম্পদের সঙ্গে তাদের মূল্যমান ১:১ অনুপাতে ধরে রাখে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য আরও নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল মাধ্যম সরবরাহ করতে পারে।