
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে সংস্কার জরুরি
বর্তমানে দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। শিল্প ও ব্যবসা খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না আসায় সামগ্রিক অর্থনীতিও এখন বেশ স্থবির। রুটিন কর্মকাণ্ডের বাইরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে যাচ্ছে না সরকার। নতুন শিল্প স্থাপন কিংবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই বেসরকারি খাতেও। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণের চাহিদা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আবার পুঁজিবাজারেও কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না।
অর্থনৈতিক স্থবিরতার পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতে চলছে নজিরবিহীন ঋণ খরা। ঋণ বিতরণ তো দূরের কথা, বেসরকারি অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের জন্য শেষ ভরসা হওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক অর্থাৎ সোনালি, জনতা, অগ্রণী ও রুপালি ব্যাংকের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুবই নাজুক। ঋণ বিতরণ আগের মতো বেড়ে না গিয়ে কমেছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো।
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ব্যাংকগুলোয় এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন বেসরকারি কিছু দুর্বল ব্যাংক উদ্ধারে ব্যস্ত সরকার, তখন ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ ব্যাংকগুলো সংস্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যদি এখনই এ ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন, একীভূতকরণ ও কার্যকর সংস্কার শুরু না হয়, তবে এসব ব্যাংক অর্থনীতিকে সহায়তা করার পরিবর্তে একসময় অর্থনীতির জন্য আরো বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালি, জনতা, অগ্রণী ও রুপালি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে চার ব্যাংকের ঋণ স্থিতি নেমে এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়। গত ছয় মাসে তা না বেড়ে উল্টো ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা কমেছে। কেবল ঋণ বিতরণে হতাশাজনক চিত্রই নয়, বরং গত ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোর অন্য সব আর্থিক সূচকেও অবনমন হয়েছে।
জুন শেষে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়। বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশই এখন খেলাপি। বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের কাছাকাছি খেলাপি হওয়ায় সেটি ব্যাংকের মূলধন ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতিও যথাযথভাবে রাখা হচ্ছে না। এটি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার প্রমাণ। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সঞ্চিতি ঘাটতি এবং ঋণ বিতরণের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে এ ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করার পরিবর্তে এখন নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে।