
জুলাই সনদ: গণভোটে বাড়বে বিভাজনের ঝুঁকি
রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। দুটি ভিন্ন পথ। একদিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক মন্দা, বৈশ্বিক সংকটসহ অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে ‘জুলাই সনদ’বিষয়ক ঐকমত্যে পৌঁছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথপরিক্রমা।
‘জুলাই সনদ’ এই বছরের জুলাই মাসেই গৃহীত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেই সময়সীমা পার হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ দুবার বাড়ানো সত্ত্বেও এখনো কোনো সমাধান আসেনি। তৃতীয় মেয়াদের সময়সীমা তথা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের আস্থা ও সংস্কারের সম্ভাবনা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে ২০২৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেও, নিউইয়র্কে মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এক সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘কিছু শক্তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে নির্বাচন যেন অনুষ্ঠিত না হয়...এর সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের বিপুল অর্থ জড়িত...আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এই কারণেই সব বিভেদ, বিভাজন, আস্থাহীনতা ও অনিশ্চয়তার অবসান খুবই জরুরি।
বিভাজনের পথ
আশার কথা, জুলাই সনদের বিষয়বস্তু নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি এই বিতর্ককে আরও উসকে দিচ্ছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রের মূল কাঠামো নিয়ে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দীর্ঘ মেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে।
জুলাই সনদের কয়েকটি বিষয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারী ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ‘নোট অব ডিসেন্ট’–সংক্রান্ত বিষয় গণভোটের প্রস্তাব করছেন। ঐকমত্য ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’–সংক্রান্ত বিষয় আলাদা প্যাকেজে ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করতে বলছেন। ঐকমত্য কমিশন এই পদ্ধতি সুপারিশ করলে ভোটারদের ফাঁদে ফেলবে। গণভোটে এই প্রক্রিয়ায় কোনো প্রস্তাবের সমর্থন ও অন্যটির বিরোধিতা করার সুস্পষ্ট মাধ্যম নেই। এইভাবে বিভাজনকে বৈধতা দেওয়া একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ।
সবারই জানা, গণভোট পূর্ব-বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে ঐকমত্যকে ভিত্তি দান করে। যেমন ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ক্ষেত্রে সব দলের সমঝোতা ছিল এবং গণভোট ঐকমত্যকেই অনুমোদন দিয়েছিল। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না?’ এই সংশোধনীতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বর্তমানের ‘নোট অব ডিসেন্ট’–এর বিষয়গুলোতে ঐকমত্য নেই। নারী আসনের মতো অগ্রগতিশীল বিষয় যদি গণভোটে আটকে যায়, তবে ভবিষ্যতে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ হয়ে পশ্চাৎপদ অবস্থান স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে।
‘জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গণভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ মেটানোর চেষ্টা নতুন সংকট সৃষ্টি করবে। যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে প্রত্যাহার (ব্রেক্সিট) বিষয়ক গণভোট অচলাবস্থা ভাঙার বদলে গভীর বিভাজন ডেকে আনে। বাংলাদেশের জন্য এমন ঝুঁকি নেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। গণভোট দিয়ে বিভক্তিকে বৈধতা দেওয়ার পরিণতি ভয়াবহ। রাজনীতির আলাপ–আলোচনায়ই রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠতে হবে।
স্মর্তব্য যে ঐকমত্য কমিশন ও তাদের বিশেষজ্ঞরা জুলাই সনদের আইনি কাঠামো দিতে ‘জুলাই ঘোষণা’র ২২ অনুচ্ছেদের অধীনে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ঘোষণার ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, এটি বাস্তবায়িত হবে পরবর্তী নির্বাচনে গঠিত সংসদ দ্বারা। সুখের খবর, তাঁরা এই পথ অনুসরণ করেননি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক ডিক্রি বা আদেশের মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর-বিষয়ক আরেকটি বিভাজনকারী প্রস্তাব রয়েছে। এমন পদ্ধতি বৈধতার ঘাটতিতে আক্রান্ত। পাকিস্তানে সামরিক শাসকগোষ্ঠী ডিক্রির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষয় করেছে। লাতিন আমেরিকায় সংসদীয় তত্ত্বাবধান ছাড়াই জারি করা প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রি দীর্ঘস্থায়ী সাংবিধানিক সংকটের জন্ম দিয়েছে।
সব কক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর দাবিতে আন্দোলন চলছে। যদিও ‘জুলাই ঘোষণা’য় নিম্নকক্ষে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানবিষয়ক ঐকমত্য রয়েছে; এই বিষয়ে কোনো দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়নি। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা তখনই কার্যকর হয়, যখন একটি দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী এবং নির্বাচনী সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো প্রেক্ষাপটে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামো অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত, প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনগণের আস্থা এখনো পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নতুন জটিলতা তৈরি করবে। যেমন শ্রীলঙ্কায় মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা রাজনৈতিক বিভাজন হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। নেপালে ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার বাদে ১৩ বার সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান মুহূর্তে স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। নতুন কোনো জটিলতা এই চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত।