সিলিকন ভ্যালির হাসি-কান্না
আমাদের দেশে এমন কেউ কি আছেন, যার হাতের মুঠোয় একটি মোবাইল ফোন নেই? আছেন নিশ্চয়ই—তবে তারা বিরল হতে চলেছেন। প্রায় সবার হাতেই মোবাইল ফোন আছে। কারওটা খুব স্মার্ট, কারওটা তুলনামূলক সস্তা; কেউ ব্যবহার করেন অ্যাপলের আইফোন, আবার কেউ ভরসা করেন গুগলের অ্যান্ড্রয়েডে। কম্পিউটারও এখন অনেকের বাড়িতেই আছে। কোথাও ডেস্কটপ, কোথাও ল্যাপটপ, কারও ম্যাকিনটোশ, কারও উইন্ডোজ, আবার কেউবা আইপ্যাডেই সব সারেন। প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা আরও কত রকমের ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করি। নাম বাড়িয়ে কাজ নেই—অনেক কিছুই এখন লাইসেন্স নিয়ে বাংলাদেশেই তৈরি হয়, এটাই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় লক্ষণ।
যে দেশেই এগুলো এখন তৈরি হোক না কেন, এসব প্রযুক্তির আবিষ্কার ও উৎপত্তি হয়েছে এক ছোট্ট জায়গা থেকে—যাকে আমরা বলি সিলিকন ভ্যালি। নবীন-প্রবীণ কত উদ্ভাবক, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ সেখানকার ল্যাবে রাতদিন শ্রম দিয়েছেন। তাদের মেধা ও শ্রমে আজকের পৃথিবী এতটা বদলে গেছে। এসব প্রযুক্তি ছাড়া এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রায় অচল। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে বাংলাদেশি প্রযুক্তিবিদরাও যান সিলিকন ভ্যালিতে, নতুন উদ্ভাবনের ধারা ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজেদের যুক্ত করতে। অনেকের কাছে এটি শুধু কর্মস্থল নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির স্পন্দন ছুঁয়ে দেখার এক বিরল সুযোগ।
কোথায় সেই সিলিকন ভ্যালি, যেখানে যেতে দুনিয়ার টেকনোলজিপ্রেমী মানুষজন ব্যাকুল? যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরীয় এলাকার ঠিক দক্ষিণে—সান হোজে, সান্তা ক্লারা, মাউন্টেন ভিউসহ আশপাশের অঞ্চলগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছে সিলিকন ভ্যালি। মজার বিষয় হলো, ভূগোলের দিক থেকে জায়গাটি বিশেষ বড় কিছু নয়, কিন্তু বিশ্ব প্রযুক্তি–বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে ছোট্ট এই জায়গাটিই।
সিলিকন ভ্যালি নাম এসেছে কম্পিউটারের ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরির কাজে ব্যবহৃত পদার্থ সিলিকন থেকে, যা পিরিয়ডিক টেবিলের ১৪ নম্বর উপাদান। খুব বেশি আগে নয়, বিগত শতাব্দীর সত্তরেরদশকের প্রথম দিকে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সীমাহীন উদ্ভাবনী চেষ্টার সঙ্গে সাফল্যের জীবনধারা এক নতুন জগতের জন্ম দিয়েছে।
এখানেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, যা প্রযুক্তি–উদ্ভাবনের অন্যতম অন্যতম উৎস। এখানেই জন্ম নিয়েছে হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচ-পি), ইন্টেল, অ্যাপল, গুগলের মতো বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি। আবার এখানে অনেকে আশা নিয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন, কিন্তু সাফল্য পাননি—নিঃশেষ হয়েছেন আর্থিক ও মানসিকভাবে। সিলিকন ভ্যালি শুধু সাফল্যের গল্প নয়, ব্যর্থতার কাহিনিও কম নয়।
এই সিলিকন ভ্যালিতে গ্যারেজ থেকেই জন্ম নিয়েছে কত কোম্পানি, যেগুলো পরে বিশ্বের বৃহত্তর ও সম্মানিত হাইটেক কোম্পানির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। সিলিকন ভ্যালির কুপারটিনোতে অ্যাপলের সুরম্য প্রধান কার্যালয়ের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম—এই কোম্পানিটি মাত্র কয়েক দশক আগে স্টিভ জবসের বাবা-মায়ের গ্যারেজে জন্ম নিয়েছিল। দুই বন্ধু, স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াক, ছিলেন অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা। গ্যারেজের ছোট্ট পরিবেশ থেকে উঠে আসা এই কোম্পানি আজ কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে—এটাই প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য ক্ষমতা।