শরৎ এসেছে। এ যেন এক অনুপম কবিতা, যা বারবার নতুন করে ছুঁয়ে যায় মনকে। তপ্ত গ্রীষ্মের দীর্ঘ দাবদাহ থেকে মুক্তি আর শীতের কোমল আগমনি বার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মোহময় এক অপরূপ সুরে। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো তুলার মতো শুভ্র সাদা মেঘ, দোল খাওয়া কাশফুলের সমারোহ; সব মিলিয়ে শরৎ প্রকৃতিকে সাজায় শান্তি ও প্রশান্তির অপরূপ রঙে। এ মনোরম ঋতুতে শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হৃদয়ে জাগায় এক ভিন্ন উৎসবের আবেগ। এ যেন এক অনন্য অনুভূতি। প্রকৃতির রূপ ও উৎসবের উচ্ছ্বাস যেন এক সুরেলা বন্ধনে মিলে যায়, আর তারই মাঝে বাঙালি খুঁজে পায় শারদীয় উৎসবের প্রকৃত আনন্দ ও আমেজ।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ যিনি সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী, অশুভের অবসান ঘটিয়ে শুভের প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির পরম রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। পুরাণ কথায় আছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে অগ্নিতেজের মতো অসংখ্য রশ্মি নির্গত হয়ে এক বিশাল আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়েছিল। সেই আলোকপুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হন মহাশক্তি, মহামায়া দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত এ দেবী একে একে অসুরকুলকে বিনাশ করে স্বর্গে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শান্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দশভুজা দুর্গার প্রতিটি হাতের অস্ত্র একেকটি দিকের প্রতীক। অর্থাৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ঈশ্বরের উপস্থিতি বিরাজমান। মা দুর্গার ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা সৃজন, পালন ও সংহারের প্রতীক। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চক্রে তিনিই নিয়ন্ত্রিণী। তিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন, আর শিবরূপে সংহার করেন। অতএব, তিনি বিশ্ব প্রসারিণী, মাতৃরূপিণী শ্রীশ্রী দুর্গা।
মহোৎসবের মহিমা : বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পালিত এ উৎসবকে বলা হয় দুর্গাপূজা বা দুর্গা উৎসব। দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে এটি শরৎকালের মহাউৎসব হিসাবে উদযাপিত হয়, তাই এর আরেক নাম শারদীয় উৎসব। আশ্বিন মাসের মহালয়ার অমাবস্যা থেকে শুরু হয়ে দশমী পর্যন্ত উৎসব চলে ধারাবাহিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে-ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী। অন্যদিকে, বসন্তকালে দেবীর আগমনকে বলা হয় বাসন্তী পূজা বা অকালবোধন। দেবী দুর্গা ব্রহ্মশক্তির স্বরূপিণী, বিভাসিতা মাতৃশক্তি, জগজ্জননী। তিনি জীবজগতে বিরাজমান চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, দয়ারূপে এবং শ্রদ্ধারূপে।
২০২৫ সালের দুর্গোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য : ‘অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভশক্তির জাগরণ।’ আজকের পৃথিবীতে যখন অন্যায়, সহিংসতা, বৈষম্য ও অশান্তি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন দুর্গোৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেব-দেবীর মতো আমরাও অশুভকে পরাভূত করে শুভশক্তিকে জাগ্রত করতে পারি।
দুর্গার নাম ও মাহাত্ম্য : দুর্গা নামের প্রতিটি অক্ষরেই নিহিত রয়েছে একেকটি গভীর তাৎপর্য। ‘দ’ দৈত্যনাশক, ‘উ’ বিঘ্ননাশক, ‘র’ রোগনাশক, ‘গ’ পাপনাশক, ‘আ’ ভয় ও শত্রুনাশক। অতএব, যিনি দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় থেকে আমাদের রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। চণ্ডীতে বর্ণিত আছে-দুর্গম নামক অসুরকে বধ করার পর দেবীর নামকরণ হয় দুর্গা। দুর্গম অসুরের উদ্দেশ্য ছিল জীবজগৎকে দুর্গতিতে ফেলা। তাকে বধ করে দেবী-দেবতাদের হারানো আসন ফিরিয়ে দেন, আর মানবজাতিকে অশুভের হাত থেকে রক্ষা করেন।
মহিষাসুর ও প্রতীকী তাৎপর্য : দেবীর পদতলে মহিষাসুর অশুভ ও অহংকারের প্রতীক জগতের অমঙ্গলের মূল। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করতে আবির্ভূত হন। তার প্রতিমায় প্রতিফলিত হয় শৌর্য-বীর্য (কার্তিক), জ্ঞান-ভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ) এবং সম্পদ (লক্ষ্মী)। মানুষের ইহজীবনের কল্যাণ, ভৌতিক প্রাপ্তি এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়-সবই এ পূজার আধ্যাত্মিক বার্তায় নিহিত।
আচার-অনুষ্ঠান : প্রাচীন শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ব বৃক্ষের নিচে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ-যেখানে কলাবউ সাজানো হয় বধূর আকৃতিতে এবং দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। অষ্টমীতে মহাষ্টমীর পূজা ও নব