আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়তে ভর্তি হই, তখনো কল্পনা করিনি যে আমাদের এই খাত এত বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসি বিভাগ আজ এমন সব স্নাতক তৈরি করেছে, যারা দেশি ও বিশ্বের নামী ওষুধ কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অসামান্য অবদান রাখছে।
একজন শিক্ষক ও ডিন হিসেবে আমার গর্ব হয় যখন দেখি শত শত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছে বা দেশে থেকে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পকে এক বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তর করেছে। বর্তমানে হাজারো দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি, গবেষণা ও উন্নয়ন, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিপণনে কাজ করছে, যা জাতীয় অগ্রগতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।
আমার কর্মজীবনে আমি এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছি। বহু দশক ধরে ওষুধের মূল ভরসা ছিল ছোট আণবিক রাসায়নিক উপাদান। বাংলাদেশ এই খাতে দক্ষতা অর্জন করেছে-জেনেরিক ওষুধে আত্মনির্ভর হয়েছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সাশ্রয়ী দামে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দী নতুন এক বিপ্লব নিয়ে এসেছে— বায়োলজিকস।
জীবিত কোষ থেকে তৈরি এই অ্যাডভান্স ওষুধ (প্রোটিন, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ও ভ্যাকসিন) ক্যানসার, অটোইমিউন রোগ ও সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। ছোট আণবিক ওষুধ এখনো গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে বায়োলজিকসের।
২০০৭ সাল থেকে ওষুধশিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অল্প কিছু ওষুধের মাধ্যমে শুরু হলেও আজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করছে ডায়াবেটিসের জন্য ইনসুলিন, রক্তাল্পতার জন্য এরিথ্রোপয়েটিন, ক্যানসার ও অটোইমিউন রোগের জন্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এবং জলাতঙ্ক, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস-বি, কলেরা ও সার্ভিক্যাল ক্যানসারের (এইচপিভি) ভ্যাকসিন। একসময় বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যে আমদানি করতে হতো এসব ওষুধ; এখন এগুলো দেশের ভেতরেই বিশ্বের অন্যতম সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, কিছু প্রতিষ্ঠান এখন পুরোপুরি ‘ভার্টিকালি ইন্টিগ্রেটেড’ অর্থাৎ কোষ থেকে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া-ফারমেন্টেশন, পরিশোধন, প্যাকেজিং পর্যন্ত—দেশেই করছে। এটি বৈশ্বিক মানের জৈবপ্রযুক্তি, যা বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি এখন বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলোর সমকক্ষ পর্যায়ে কাজ করছে। তারা আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানি, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়ন, হস্তান্তর, উৎপাদন, গবেষণা, বিপণন ও নজরদারিতে কাজ করছে। এমনকি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খ্যাতনামা বৈশ্বিক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে ইস্টভিত্তিক ও এমআরএনএ প্রযুক্তির মতো নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, যা জরুরি স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ।