
শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে কার্যকরভাবে মেলানো দরকার
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বড় অর্জন হলো উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের বিস্তার। গ্রাম থেকে শহর তথা দেশজুড়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ জমে উঠছে, যেটি হলো গ্র্যাজুয়েট বেকারত্ব। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ঢাকা বিভাগে তরুণ স্নাতকদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশই বেকার।
সংখ্যাটি শুধু পরিসংখ্যান নয়; এটি আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক বাস্তবতার এক তীব্র দুঃখজনক প্রতিফলন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ গ্র্যাজুয়েট বেকার। জাতীয় বেকারত্বের হার যদিও ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু শিক্ষাগত স্তর যত ওপরে যাচ্ছে, বেকারত্বের হার তত বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন তরুণ যখন গ্রামে ফেরেন বা শহরে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তখন তাঁর কাছে ডিগ্রির মর্যাদা ম্লান হয়ে যায়। চাকরি নেই, নেই কাজের নিশ্চয়তা। শুধু ডিগ্রি অর্জনই এখন আর কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।
ঢাকা বিভাগের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ হার দেখায়, রাজধানী ও আশপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্নাতক ডিগ্রিধারীর সংখ্যা যেমন বেশি, প্রতিযোগিতাও তেমন তীব্র। এখানে একদিকে চাকরির চাহিদা সীমিত, অন্যদিকে প্রত্যাশা অনেক বেশি। ফলে অনেকেই দীর্ঘ সময় ধরে কাজ খুঁজেও সুযোগ পান না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যেসব চাকরি পাওয়া যায় সেগুলোর সঙ্গে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সামঞ্জস্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো বিষয় আর শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে যে ব্যবধান, সেটিই আজকের বড় সমস্যা। এই সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী যুব বেকারত্বের হার প্রায় ১৩ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো—ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল—সবখানেই শিক্ষিত বেকারত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতেও প্রায় একই চিত্র দেখা যায়; অনেক তরুণ প্রকৌশলী বা স্নাতক হয়েও উপযুক্ত কাজ না পেয়ে বিকল্প পেশায় নামছেন। এমনকি ভারতের একটি খবরে প্রকাশ পেয়েছে যে সেখানে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে আবেদন করছে। এ চিত্র শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই আজ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের বেহাল পরিস্থিতি।
মালয়েশিয়ায়ও শিক্ষিত বেকারত্ব একসময় তীব্র আকার ধারণ করেছিল, যদিও তারা টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিয়েছে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো যেমন জার্মানি বা জাপান, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রমবাজারের মধ্যে নিবিড় সংযোগ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করার আগেই প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ফলে তাঁদের চাকরিতে প্রবেশ তুলনামূলক সহজ হয়। এই বৈষম্য আমাদের স্পষ্ট শেখায় যে শুধু উচ্চশিক্ষার প্রসার নয়, সেই শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করাই মূল চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে সমস্যাটিকে জটিল করেছে আরো কিছু বাস্তবতা। প্রথমত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোর্সের নকশা এখনো অনেকাংশে পুরনো ধাঁচের। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা ব্যবসায় শিক্ষায় আধুনিকায়নের কিছু প্রচেষ্টা থাকলেও মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের মতো শাখায় স্নাতকরা প্রায়ই বাজার চাহিদার বাইরে পড়ে যান। দ্বিতীয়ত, শিল্প ও বেসরকারি খাত সম্প্রসারণে যেমন বাধা আছে, তেমনি সরকারি খাতও নতুন চাকরি সৃষ্টিতে খুব ধীর। প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ পাস করছেন, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে সীমিত সংখ্যায়। তৃতীয়ত, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি অনেক তরুণকে হতাশ করছে। যোগ্য হয়েও অনেকে সুযোগ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ক্ষমতার প্রভাবে অনেকেই সুযোগ নিচ্ছেন।
তবে এই সংকটকে শুধু সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না, এটিকে একটি সুযোগ হিসেবেও ধরা যেতে পারে। তরুণরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন খাত সৃষ্টি করতে পারলে অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাত, ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ, কৃষিভিত্তিক শিল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানি—এসব ক্ষেত্র বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। সরকার ও বেসরকারি খাত যদি একসঙ্গে এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়ায়, তবে শিক্ষিত তরুণদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে।