অচিন পাখি উড়ে গেলেন আকাশের ওপারে

বিডি নিউজ ২৪ চিররঞ্জন সরকার প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:১১

ঝরে গেলেন বাংলার সংগীত আকাশের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র। নাম তার ফরিদা পারভীন। তার কণ্ঠ শুধু কণ্ঠ ছিল না, ছিল যেন কোনো অলৌকিক আশীর্বাদ—এক অদৃশ্য স্পর্শ, যা লালন সাঁইয়ের অমর বাণীকে বাংলার প্রতিটি পথ-প্রান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছে, মানুষের হৃদয়ের গভীরে অমোঘ ছাপ এঁকে দিয়েছে। তাই যখন তার বিদায়ের খবর কানে এলো, তখন হৃদয়ের ভেতর নেমে এলো সীমাহীন শূন্যতা, এক অদ্ভুত হাহাকার। মনে হলো যেন শুধু একজন শিল্পী নয়, বিদায় নিলেন এক যুগ, থেমে গেল এক সুরের নদীর অনন্ত স্রোতধারা। পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে আমাদের চিরচেনা হাসি, প্রাণোচ্ছল কণ্ঠ আর অনন্ত সুর চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল।


ফরিদা পারভীনের গান বাংলার আত্মার সুর হয়ে যুগে যুগে ধ্বনিত হয়েছে। এই কিংবদন্তি শিল্পী শুধু একজন গায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবন্ত ইতিহাস, বাউল ফকিরদের গভীর দর্শনের নিবেদিতপ্রাণ দূত। তার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান যেন নতুন প্রাণ পেত, সহজ-সরল বাণী হয়ে যেত মানুষের অন্তরের দিকনির্দেশ। যে-ই তার গান শুনেছে, অনুভব করেছে—এ কণ্ঠ কেবল সংগীত পরিবেশন করছে না, বরং হৃদয়ের অন্তর্লোক উজ্জ্বল করে দিচ্ছে আধ্যাত্মিক আলোর দীপশিখা।


১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঔঁল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন। শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলো কেটেছে কুষ্টিয়া ও মাগুরার প্রকৃতির কোলে। গ্রামীণ জীবনের সরলতা, নদীর স্রোত, বিলের শাপলা আর পাখির ডাক তার অন্তরে সুরের বীজ বপন করেছিল খুব অল্প বয়সেই। চঞ্চল আর কৌতূহলী ফরিদা ছোটবেলা থেকেই গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসতেন। রেডিওতে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান বাজত, তখন ছোট্ট ফরিদা মন দিয়ে শুনতেন, কখনো আবেগে কেঁদেও ফেলতেন। গান ধীরে ধীরে তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই এসব কথা বলেছেন।


মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে তার গানের হাতেখড়ি হয় মাগুরায় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন, ফলে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হতো, আর এরই কারণে ফরিদা পড়েছেন একাধিক স্কুলে। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক, কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি চলেছে সংগীত শিক্ষা। ওস্তাদ ইব্রাহিম তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে মনোযোগী হতে, এরপর তিনি নিয়মিত তালিম নেন রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস, ওসমান গণি, আবদুল কাদের ও মীর মোজাফফর আলীর কাছে। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারে নজরুলসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। শুরুতে তার গানের দুনিয়া ছিল ক্ল্যাসিক্যাল আর নজরুলসংগীতের ভুবনে, তবে ভাগ্য তাকে টেনে নিয়ে যায় আরও গভীর আর আধ্যাত্মিক এক জগতে—লালন গানের ভুবনে।


স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালে তার জীবনের বড় মোড় ঘোরে। গুরু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তিনি প্রথম লালনের গান শেখা শুরু করেন। তার শেখা প্রথম গান ছিল ‘সত্য বল সুপথে চল’। সেই শুরু, তারপর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছ থেকেও তিনি তালিম নেন। ধীরে ধীরে লালনের গানের গভীর দর্শন তাকে আলোড়িত করতে থাকে। শুরুতে কিছুটা অনীহা থাকলেও শীঘ্রই তিনি উপলব্ধি করেন, লালনের গান কেবল সংগীত নয়, এটি এক জীবনদর্শন। তার নিজের স্বীকারোক্তি, “লালনের গান আমার আত্মার খোরাক।” তাই তিনি এই গানের মধ্যেই খুঁজে পান জীবনের অর্থ, মানুষের প্রতি ভালোবাসার দীক্ষা আর মনুষ্যত্বের শিক্ষা।


ঢাকায় এসে তিনি বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত গাইতে শুরু করেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের অনুরোধে তিনি লালনের গান রেকর্ড করেন ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় এক অনন্য যাত্রা। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’—এসব গান তার কণ্ঠে মানুষের অন্তরে গেঁথে যায়। মানুষ শুধু গান শোনেনি, অনুভব করেছে ভেতরের দার্শনিক আলো। ফরিদা পারভীনের গায়কীতে ছিল সহজ সরল আবেগ, আধ্যাত্মিক প্রকাশ আর মাটির গন্ধ। তার গানে লালনের দার্শনিক বাণী সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও