
যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ!
কাতারের ওপর ইসরাইলি বিমান হামলা কি কেবল হামাসের অবশিষ্ট শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ছিল? মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি যে দেশে অবস্থিত, সেই সুখী, ধনী ও নিরাপদ দেশ কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে লালিত ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকে না জানিয়ে হামলা চালিয়েছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তেল আবিব থেকে দোহায় উড়ে আসতে ও বিমান হামলা চালিয়ে আবার তেল আবিবে ফিরে যেতে ইসরাইলি বিমানকে জর্দান, সিরিয়া, ইরাক ও সৌদি আরব-এ চারটি দেশের ২,৭০০ মাইলের বেশি আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে হয়েছে, অথচ দেশগুলোর রাডারে কিছুই ধরা পড়ল না-এটাই বা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? কোনো বিশ্লেষণেই এ প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কারণ সবাই জানে, ইসরাইলের যে কোনো পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী খুঁটির জোরেই ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সব মুসলিম দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। সোজা কথায় বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুরোদ সম্পর্কে ইসরাইল ভালোভাবে জেনেই তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা সমগ্র পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলকে তাদের সার্বক্ষণিক হামলার হুমকির মধ্যে রেখেছে। হুমকি বাস্তবায়নের প্রথম শিকার যে কাতার হবে, তা কেউ ধারণা করতে পারেনি।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো কাতারে ইসরাইলি বিমান হামলার নিন্দা করার মধ্যে কথার ফাঁক রেখেছে। ইসরাইল কোথায় আক্রমণ করেছে সেটা মুখ্য নয়, ইসরাইল কাকে টার্গেট করেছে সেটিই মুখ্য বিষয়। শক্তিশালী দুটি দেশ রাশিয়া ও চীন ইসরাইলি হামলার কঠোর নিন্দা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বেশ মজার। হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র ক্যারোলিন লিভিটের মতে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলার স্থান সম্পর্কে অসুখী। আসলে কি তিনি অসুখী? হামলার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ১১ সেপ্টেম্বর দুই দফা কথা বলেছেন ট্রাম্পের সঙ্গে এবং তিনি জোর গলায় বলেছেন, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অভিন্ন এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হামাসকে সহায়তাদানকারী যে কোনো দেশের ওপর হামলা চালাতে ইসরাইল দ্বিধা করবে না।
কাতারে হামাস নেতাদের অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অবহিত। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়েই কাতার তার ভূখণ্ডে হামাসকে অফিস স্থাপনের ও তাদের নেতাদের বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। হামাস সেখানে আলোচনা করছিল গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি নিয়ে। কিন্তু হামলা চালিয়ে ইসরাইল গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার সব সুযোগ ইচ্ছাকৃতভাবে বিনষ্ট করেছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কাতারে হামাসের সঙ্গে শান্তি আলোচনা প্রসঙ্গে সবকিছু জানত। কোনোকিছু আড়ালে ছিল না বলে দাবি করেছে কাতার সরকার। তা সত্ত্বেও এ হামলায় ইসরাইলের ভূমিকা স্পষ্ট-তারা গাজা নিয়ে কোনো আলোচনার ধার ধারে না। তারা আরব দেশগুলোকে কোনো পরোয়া করে না। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে দায়মুক্তি দিয়েছে, তাদের দ্বারা যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনসহ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতেও ইসরাইলকে তারা স্বাধীনতা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও কাতারের নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন, কাতারি ভূখণ্ডে আর কোনো হামলার ঘটনা ঘটবে না; কিন্তু ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হামাস নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে আবারও কাতারের ওপর হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। কাতার যুক্তরাষ্ট্রকে পরম মিত্র বিবেচনা করলেও কাতারের ওপর ইসরাইলের হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের বক্তব্য যে প্রতারণামূলক ছিল, তা বোঝা যায় তার বক্তব্যে। তিনি প্রথমে দাবি করেছিলেন, তিনি হামলা সম্পর্কে কাতারকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কাতার ট্রাম্পের দাবি অস্বীকার করে। ট্রাম্প দ্রুত তার আগের বক্তব্য শুধরে বলেন, কাতারে নিযুক্ত আমেরিকান দূতকে যখন হামলা সম্পর্কে অবহিত করা হয়, তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, গত দুই বছরে ইসরাইল হামাসকে নেতৃত্বশূন্য করতে সংগঠনটির রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ইয়াহিয়া সিনাওয়ার এবং সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দিয়েফকে হত্যা করেছে। তা সত্ত্বেও হামাস সীমিত শক্তি দিয়ে বিমান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া বহরসহ অত্যাধুনিক সামরিক মারণাস্ত্রসমৃদ্ধ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের যানবাহন ও ভারী অস্ত্র ছাড়াই গত দুই বছর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি হামলা শুরু হওয়ার পর গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে বহু বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও রসদসহ যুদ্ধ অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী সরবরাহ করেছে। যদিও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, ইসরাইলিদের দ্বারা গাজায় ফিলিস্তিনি গণহত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট উদ্বিগ্ন এবং ইসরাইলি আচরণে তারা হতাশ, কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গাজায় গণহত্যা চালানো ছাড়াও সেখানে মানবিক সাহায্য প্রেরণে ইসরাইলের ক্রমাগত বাধায় বেঁচে থাকা ফিলিস্তিনিরা যখন ক্ষুধা-পিপাসায় তড়পাচ্ছিল, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রস্তাব করেছেন গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে উৎখাত করে, গাজাকে জনশূন্য করে তাদের আশপাশের দেশে পুনর্বাসনের। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। গাজাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করতে পারলে ইসরাইলের পক্ষে ফিলিস্তিন অধ্যুষিত ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরকেও ইসরাইলের সঙ্গে যুক্ত করা সহজ হবে। ইসরাইলি প্রবক্তাদের কথায় তা-ই ফুটে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে ধোঁকা দিয়ে অতি জাতীয়তাবাদী ইসরাইলিদের দ্বারা সমর্থিত ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ গড়ে তোলার সম্প্রসারণবাদী ধারণা বাস্তবায়নে দেশটিকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যেই কাজ করছে ইসরাইল। অধিকৃত পশ্চিম তীর ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর পরই ইসরাইল হাত বাড়াবে লেবানন, সিরিয়া, মিসর ও জর্দানের কিছু অংশ দখল করতে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ উত্থাপন করেছে বিশ্বের অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা। কিন্তু ইসরাইলি সরকার অথবা তাদের শক্তির উৎস যুক্তরাষ্ট্র ভ্রুক্ষেপও করেনি এসব অভিযোগের প্রতি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনী গাজায় ৬৫,৬৫৬ জনের অধিক ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছে। তবুও হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থেমে নেই ইসরাইল। ২৫ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ১৪১ বর্গমাইল আয়তনের গাজা উপত্যকা এখন কার্যত ইসরাইলি দখলে, ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংযুক্তির ঘোষণা কেবল বাকি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ইসরায়েলের হামলা