
বাংলাদেশে বিভিন্ন বন্ড নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এর অগ্রগতি তেমন কিছুই হয়নি। ‘সুকুক’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের আমানতকারীদের অনেকেরই ধারণা নেই। সুকুক হচ্ছে ইসলামি বন্ড। ইসলামি ফাইন্যান্সের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে সুকুক বন্ড। এটি বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও নৈতিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা। এটা হচ্ছে ইসলামিক ফাইন্যান্স নীতিমালা (শরিয়া) মেনে তৈরি করা একটি অ্যাসেট-ব্যাকড সিকিউরিটি। অন্যান্য বন্ড থেকে এটি কিছুটা ব্যতিক্রম। যেমন, এটি সাধারণ বন্ডের মতো সুদ না দিয়ে, অ্যাসেট থেকে যে আয় হয় তা থেকে লভ্যাংশ প্রদান করে। বাংলাদেশে সরকার ও করপোরেশনগুলো অবকাঠামো প্রকল্পে তহবিলের ব্যবস্থা করার জন্য সুকুক ইস্যু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার ৫০০ কোটি টাকার সুকুক ইস্যু করল একটি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য। এখানে বিনিয়োগকারীরা সার্টিফিকেট কিনে প্রকল্পের মালিকানা পেতে পারে (যেমন : ০.০১ শতাংশ)। প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে যে আয় হবে তা থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বণ্টন করা হয়। প্রকল্পের আয়, লিজ রেন্টাল, ইত্যাদিই সুকুকের লাভের উৎস। সুকুকের ক্ষেত্রে প্রকল্পের অ্যাসেটই জামানত হিসাবে স্থিত থাকে এবং এতে ট্যাক্স সুবিধা রয়েছে। যেমন সরকারি সুকুকে ১০ শতাংশ ট্যাক্স রিবেট (সাধারণ বন্ডে ১৫ শতাংশ) রয়েছে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য সুকুক হচ্ছে শরিয়াভিত্তিক সুদমুক্ত লাভ প্রাপ্তির একটি বিনিয়োগব্যবস্থা। সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণে এতে ঝুঁকি কম এবং নিয়মিত লাভের ভাগ প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও রয়েছে। মেয়াদ শেষে সম্পূর্ণ মূলধন ফেরত দেওয়া হয়। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, প্রকল্পের আয় কমলে লাভের ভাগ কমতে পারে। তবে এটা বিরল।
সুকুক ছাড়া অন্যান্য বন্ড হচ্ছে সুদভিত্তিক বন্ড। যেহেতু আমাদের দেশের আমানতকারীদের একটা অংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান, তাই অন্যান্য বন্ডের প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট নয় তারা। তবে সুকুক শরিয়াভিত্তিক হওয়ায় এই বন্ডের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা উচিত ছিল। অথচ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা হয়নি। সুকুক আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ আছে এখন পর্যন্ত। ব্যক্তিগতভাবে সুকুক ইস্যু করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত সুকুক তো ভালোই চলছে। সবাই ঠিকমতো লভ্যাংশ পাচ্ছে। এগুলোর রিডেনশন হবে ডিসেম্বর ২০২৬-এ। আশা করা যায়, রিডেনশনে তারা আসল ফেরত পাবে। আইসিবি নিজেই এটার ট্রাস্টি এবং এসটিডি। এটার রিকোয়ারম্যান আছে রেগুলেটরের।
এবার করপোরেট বন্ডের কথায় আসি। আসলে করপোরেট বন্ড বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এটার প্রতি মানুষের বিশ্বাস এখন আর নেই বললেই চলে। করপোরেট বন্ড ইস্যু করতে সক্ষম বড় বিজনেস হাউজগুলোর কেউ ইস্যু করেনি। করলেও তা এখন চলবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
আর বাকি আছে সরকারি বন্ড। সরকারি বন্ডকে ট্রেজারি বন্ডও বলা হয়। এ ট্রেজারি বন্ড সরকার বাজেটের ঘাটতি পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অকশনের মাধ্যমে জনগণের কাছে এগুলো বিক্রি করে। তা গত ছয় মাস আগে বা গত এক-দেড় বছর আগে যথেষ্ট পরিমাণে হাই ইন্টারেস্ট বিয়ারিং ছিল। এ ইন্টারেস্ট পার ইয়ার ১২.৫০ পর্যন্ত উঠেছে। এখন অবশ্য এটা কমে গেছে। সরকারি ট্রেজারিতেও অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিনিয়োগ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, এগুলোর সেকেন্ডারি মার্কেট অতটা লিকুইড না। ইচ্ছা করলেই এগুলো বিক্রি করা যায় না। শেয়ার যেভাবে বিক্রি করে দিতে পারে এগুলো সেভাবে বিক্রি করে দিতে পারে না। এখন অবশ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। সরকারি ট্রেজারি বন্ড, সুকুক ইত্যাদি এখন বিক্রি করা যায়। আগে তো মেয়াদ পূর্তিতে সারেন্ডার করতে হতো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। তাহলে টাকা পেত। এখন তা আর লাগে না। এখন আগেই ওটা সেন্ড করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। এতকিছুর পরও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এটা জনপ্রিয়তার কাতারে আসেনি।
ট্রেজারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলের সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। তবে এটা খুবই নগণ্য। কেননা ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা বন্ড ক্রয়ে তেমন সক্রিয় নয়। বিমা কোম্পানি, ব্যাংকিং কোম্পানির মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে বন্ডের ক্রেতা এবং এরাই আবার বিক্রেতা। অবশ্য বর্তমানে বন্ড ব্যক্তি পর্যায়ের জন্য এখন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যারা ব্যক্তি পর্যায়ে আছে, তারাও এখন সহজেই বন্ড কিনতে পারে। এক সময় ছিল তারা কিনতে পারত না। এখন শেয়ারবাজারের মাধ্যমে তারা কিনতেও পারে, বিক্রিও করতে পারে। কিন্তু তারপরও বন্ড মার্কেট সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। এর মূল কারণ হচ্ছে সরকারি বন্ডে আস্থা আছে। কারণ তারা ভালো ইন্ডারেস্ট দিচ্ছে। তবে করপোরেট বন্ডে আস্থা নেই বললেই চলে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউজগুলো বন্ড মার্কেট নিয়ে খুব একটা এগোতে পারেনি। অনেক ব্যাংকিং কোম্পানি রয়েছে যাদের মূলধন বাড়ানোর জন্য বন্ড ইস্যু করছে। ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ইত্যাদি এ তালিকায় রয়েছে। এগুলোর কাস্টমারও হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি পর্যায়ে খুব কম। তারা ভালো ইন্টারেস্ট দিচ্ছে। যেমন কেউ কেউ সাড়ে ১৩ দিচ্ছে, কেউ কেউ ১৫ পার্সেন্ট দিচ্ছে ইন্টারেস্ট। তারপরও এতে ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারী নেই বললেই চলে। ঢাকা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকের যে বন্ড ইস্যু করছে এগুলো নন-কনভার্টেবল, অর্থাৎ এগুলো শেয়ারে রূপান্তর হবে না। এগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে অতটা বেচাকেনাও হয় না। এগুলোর বেশিরভাগ কাস্টমার হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের বন্ডগুলো কেনে এবং বিক্রি করে। কেননা এতে সাড়ে ১৩, ১৪-১৫ পার্সেন্ট সুদ পাচ্ছে। এগুলোর মেয়াদ কোনোটি ৭ বছর ৮ বছর ১০ বছর ইত্যাদি। এগুলো ইস্যু করতে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতি লাগে।
সিকিউরিটাইজেশনের ব্যাপারে আমাদের একটু চিন্তা করতে হবে। আগে বুঝতে হবে প্রজেক্ট সিকিউরিটাইজেশন কী। কোনো প্রকল্পের সিকিউরিটাইজেশন মানে হচ্ছে সুকুক অথবা বন্ড হিসাবে জনগণ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা। যেমন ধরি পদ্মা ব্রিজ। এটা সিকিউরিটাইজেশন হতে পারত। সুকুক হিসাবে মানুষের কাছে বিক্রি করতে পারত। কারণ এটাতে গাড়ি চলে। এ গাড়ি চলা থেকে একটা আয় আসে। যাকে টোল বলে। গাড়ি যত বেশি চলবে তত বেশি টোল আদায় হবে। এ টোল আদায় থেকে অবকাঠামো মেইনটেনেন্সের জন্য সামান্যটুকু রেখে বাকিটা যারা বন্ড হোল্ডার, সুকুক হোল্ডার তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া যায়। এতে বন্ড হোল্ডাররা কোনো বছর হয়তো ১২ পার্সেন্ট পাবে, কোনো বছর হয়তো ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ পাবে। এটা নির্ভর করবে মিনিটে কতটা গাড়ি ব্রিজের ওপর দিয়ে চলছে তার ওপর। আমাদের মেট্রোরেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পদ্মা ব্রিজ ইত্যাদি প্রকল্পের জন্য সরকার বন্ড ইস্যু করতে পারত। তাহলে সরকার একসঙ্গে অনেক টাকা পেয়ে যেত। সরকার এসব প্রকল্পের পাশাপাশি আরও ১০টি অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। এগুলো নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সিকিউরিটাইজেশন হয়নি কোনোটির। সিকিউরিটাইজেশন করে বন্ড আকারে হোক, সুকুক আকারে হোক, আগে থেকেই চালু করা উচিত ছিল। বন্ড হলে বিনিয়োগকারীরা ইন্টারেস্ট পাবে আর সুকুক হলে প্রকল্প থেকে অর্জিত লাভ থেকে এর অংশ পাবে। এগুলো চালু করলে এর একটা এসেট বেকিং থাকত এবং একটা ক্যাশ ফ্লো থাকত। এতে করে প্রকল্পের অগ্রগতি সাধন করা সরকারের জন্য সহজ হতো। সরকার বড় বড় প্রকল্পকে যদি সিকিউরিটাইজেশন করে সুকুক আকারে বা বন্ড আকারে শেয়ারবাজারে লিস্টিংয়ে আনতে পারে, তখন একটা বিশাল পরিবর্তন আসবে বলে আমার বিশ্বাস।