
বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার অপরিহার্যতা
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড গড়ার স্থান। সে হোক অক্সফোর্ড অথবা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা হয়, চিন্তার মুক্তি ঘটে, আর সমাজের আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে যেমন একজন ছাত্রের কাছ থেকে ছাত্রোচিত আচরণ প্রত্যাশিত, তেমনি একজন শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছ থেকেও দায়িত্বশীল নৈতিকতা আশা করা স্বাভাবিক।
সমাজ, পরিবার ও জাতির চোখে ছাত্র একটি নির্দিষ্ট আচরণের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়। ছাত্র যদি নিয়ম ভেঙে বেয়াদবি করে, তা গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভর নয়, বরং এটি আচরণ ও চরিত্র গঠনেরও এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। অন্যদিকে, শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি মিথ্যাচার বা অনৈতিকতার আশ্রয় নেয়, তবে সেটি আরও বেশি ক্ষতিকর, কারণ তার দায়িত্ব ছাত্রদের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত শিখছে কীভাবে সমাজে অবদান রাখতে হবে তাদের। শিক্ষার্থীরা যদি দেখে যে তাদের শিক্ষক সৎ ও দায়িত্বশীল, তবে স্বাভাবিকভাবেই তারা সেই আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে, অর্থাৎ যদি ঠান্ডা মাথায় শিক্ষক রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করেন, কোনো ব্যক্তিকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করেন, কিংবা অসত্য বর্ণনা দেন, তবে শিক্ষার্থীর মনে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। তারা হয়তো ভাববে, সততা কেবল তাত্ত্বিক কথাবার্তায় সীমাবদ্ধ, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োজন নেই। এই ধরনের বার্তা তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক, যা সম্প্রতি আমরা দেখলাম।
শিক্ষকের মূল পরিচয় হলো তার জ্ঞান, তার গবেষণা, তার নৈতিকতা এবং তার সততা। একজন শিক্ষক যদি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করেন কিংবা তা সুবিধাবাদী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে তিনি কেবল নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেন না, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কলঙ্ক চাপিয়ে দেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যিনি একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ও একাডেমিক নেতা, তার প্রতিটি আচরণে উচিত সর্বোচ্চ মানদণ্ড প্রতিফলিত হওয়া। যদি দেখা যায় যে তিনি নিজেই অসত্য প্রচার করছেন, তবে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ভুল বার্তা ছড়ায় যে ক্ষমতা থাকলেই সবকিছু করা যায়, সত্যকে বিকৃত করা যায়, অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে প্রচার করা যায়।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না, তারা সমাজকে নেতৃত্বও দেন। তাদের কথা মানুষ গুরুত্ব সহকারে শোনে। তাই একজন শিক্ষকের কাছ থেকে অসত্য, মিথ্যাচার বা পক্ষপাতিত্ব প্রত্যাশিত নয়। একজন শিক্ষক যদি কাউকে বাড়তি সুবিধা দেন, তবে সেখানে যোগ্যতার ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়। যার প্রাপ্য, সে বঞ্চিত হয়। এতে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি হয় না, পুরো সমাজের জন্য একটি ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যোগ্যতার চেয়ে অন্য কিছুর ভিত্তিতে সুবিধা পাওয়া গেলে সেই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে সমাজে গিয়ে একই ধরনের অসততা ও সুবিধাবাদ চর্চা করবে। এর ফলে একটি জাতি ধীরে ধীরে মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে।
এক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষার দিকটিও উল্লেখযোগ্য। ইসলামে অসত্য বলা কেবল একটি সাধারণ অপরাধ নয়, বরং এটিকে গুরুতর গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে অসত্য ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায় এবং পাপ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। একজন মুসলিম যদি শিক্ষক হন, তবে তার দায়িত্ব দ্বিগুণ বলে ধরে নেওয়া যায়। তাকে শুধু পেশাগতভাবে সততা নয়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সৎ ও সত্যবাদী হতে হবে। তিনি যদি মিথ্যা বলেন বা সুবিধাবাদী আচরণ করেন, তবে তিনি ইসলামের শিক্ষার বিরোধিতা করেন এবং শিক্ষার্থীদের কাছেও ভুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।