শ্রীলংকা-বাংলাদেশ-নেপাল : এরপর ভারত?

যুগান্তর নেপাল অনিকেত চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৭

নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি সাতজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী, পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে পালিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হয় ভারত, না হলে দুবাইয়ে আশ্রয় নেবেন। দেখা যাক। ওদিকে অর্থমন্ত্রীকে রাস্তায় পকেটমারের মতো ফেলে পেটানো হয়েছে। কেপি শর্মা অলির বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। মন্ত্রীদের বাড়ি জ্বলছে। নেপালি কংগ্রেসের দপ্তরে আগুন লাগানো হয়েছে। এমনকি মাওবাদী কমিউনিস্ট নেতা প্রচন্ডের বাড়িও আক্রান্ত হয়েছে। সেখানেও বিক্ষোভকারীরা গিয়ে হামলা চালিয়েছে। বিক্ষোভ থামছে না, বরং নতুন করে শুরু হয়েছে। এমনিতে এক অরাজনৈতিক চেহারায় শুরু হলেও এর পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকি পুরোনো রাজতন্ত্রের সমর্থকরাও ভালোভাবে আছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো নেপালের রাজধানী সম্পূর্ণ ছাত্র-যুবাদের দখলে। তারা সামাজিক মাধ্যমের অধিকারের দাবি ফেরত পেয়েই রাস্তা ছাড়েননি। পুলিশদের পেটানো হচ্ছে এবং মিলিটারি দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখছেন। তারা চাইছেন নতুন ব্যবস্থা, চাইছেন গুলি চালানোর বিচার, চাইছেন যাবতীয় দুর্নীতির তদন্ত। নিজেরাই বলছেন, এটা জেন-জির বিপ্লব; আমরা নতুন সমাজ তৈরি করব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তাল।


এই বিক্ষোভ আরেকটা নতুন আলোচনাকে উসকে দিচ্ছে। এই কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অস্থিরতা চোখে পড়ছে, যা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। শ্রীলংকায় এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত একটা পারিবারিক রাজবংশের মতো শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছিল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশে এক সীমিত কোটা সংস্কার আন্দোলন একটা বিশাল গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে সরকার পরিবর্তন ঘটাল। প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে বেঁচেছেন, তা আমরা দেখেছি। আর এখন নেপালে সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ একদিনের মধ্যে বেকারত্ব-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটা বৃহত্তর আন্দোলনের চেহারা খালি নিল না, এমন একটা চেহারা নিল যাতে করে সরকার পতন বলা যায় না, মানে সরকার নেই ওখানে, কেউ নেই ওখানে-প্রেসিডেন্টও নেই, প্রধানমন্ত্রীও নেই। কাজেই খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, এই গণবিক্ষোভের ঢেউ কি এবার ভারতেও আছড়ে পড়বে? গণবিক্ষোভ যদি চারধারজুড়ে হয়, তাহলে ভারতে কেন আছড়ে পড়বে না? নাকি ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা? 


শ্রীলংকার বিপর্যয় থেকে শুরু করা যাক, যেখানে অর্থনীতি ছিল একমাত্র কারণ। আগে শ্রীলংকায় অনেক রকমের জটিলতা ছিল; এবারে যা হয়েছে তার কারণ অর্থনীতি। শ্রীলংকায় গণবিক্ষোভের মূল চালিকাশক্তি ছিল কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক ইস্যু। কিন্তু এটা ছিল একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে অচল করে দিয়েছিল এবং এই সংকটের পেছনে বেশকিছু কারণ ছিল। ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকার ক্ষমতায় এসে এক অযৌক্তিক কর ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎ করে কর ছাঁটাইয়ে সরকারের রাজস্ব মারাত্মকভাবে কমে যায়। সেই সঙ্গে যোগ হয় চড়া সুদের বাণিজ্যিক ঋণের ওপর বিরাট নির্ভরতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সাল নাগাদ শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণের ৫৬ শতাংশ ছিল এই বাণিজ্যিক ঋণ; যেখানে ২০০৭ সালে এই হার ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ। আরেকটা বিরাট উদাহরণ ছিল কৃষিতে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। সরকার এক রাতের মধ্যে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে জৈব সারে চাষের ওপর জোর দিল। পরে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল; কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর আসে কিছু অপ্রত্যাশিত বহিরাগত ধাক্কা। কোভিড-১৯ অতিমারি শ্রীলংকার পর্যটনশিল্পকে সম্পূর্ণ স্থবির করে দেয়-সেখানকার বৈদেশিক টাকা রোজগারের অন্যতম প্রধান উৎস। সেটা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এ সবকিছু একসঙ্গে মিলে একটা ধাক্কা, যা শ্রীলংকার সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় নিঃশেষ করে দেয়। ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় আমদানি করতেও ব্যর্থ হয়। যখন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি হয়, নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফীতি হয়, তখন একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে; তখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হবে, আগুন লাগবে। সেই স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।


এবারে আসুন বাংলাদেশের পরিবর্তনে। আদতে এক কোটা বাতিলের আন্দোলন সরকার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়েছিল নির্দিষ্ট দাবিকে কেন্দ্র করে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার। এক সীমিত ছাত্র আন্দোলন হিসাবে এটার সূচনা হয়েছিল; কিন্তু আন্দোলন দমনে সরকারের চূড়ান্ত দমনমূলক ব্যবস্থা, পুলিশি জুলুম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একধরনের প্রতারণামূলক ভাষণ এবং দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ফলে আন্দোলন দ্রুত কোটা সংস্কারের ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে বৈষম্যবিরোধী এবং তারপর গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল, যা সাধারণ মানুষকে এর সঙ্গে যুক্ত করেছিল। সরকার প্রথমে এর গুরুত্ব বুঝতেই পারেনি। ছাত্রদের আন্দোলন কঠোর দমনপীড়ন দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল। জাতিসংঘের একটা প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী-পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। মারার জন্য গুলি চালিয়েছে। যার ফলে জুলাই-আগস্টে প্রায় ৬৫০ জন মারা যান। সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে আটক ছাত্রনেতাদের জোর করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি বের করে ভিডিও প্রকাশ করে আন্দোলন দমন করতে গিয়েছিল। কিন্তু এই কৌশলগুলো কাজে দেয়নি। জনগণের ক্ষোভ কমার বদলে তা আরও বেড়ে গিয়েছিল। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫ আগস্ট তৎকালীন সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন, সেনাবাহিনী আর জনগণের ওপর গুলিটুলি চালাতে রাজি নয়। সামরিক বাহিনীর এই নিরপেক্ষ অবস্থাই সরকারের পতনের চূড়ান্ত কারণ হিসাবে কাজ করে। দুপুর ২টার দিকে যখন সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছেন, তখন লাখ লাখ বিক্ষোভকারী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে এবং সেদিনই সরকারের পতন হয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনাটা প্রমাণ করে যে, একটা সরকার যদি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে দমনপীড়নের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে, তবে সেই দমনপীড়নই জনগণকে আরও বেশি করে উসকে দিতে পারে। একই সঙ্গে এটাও দেখায়, যে কোনো গণতান্ত্রিক বা অর্ধগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কতটা নির্ণায়ক হতে পারে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও