সংকটের সময় সমাজ কীভাবে নিজেকে রক্ষা করে এবং পুনরায় জেগে ওঠে, তা বোঝার জন্য সংকট ও স্থিতিস্থাপকতার সমাজতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল কোনো বিপর্যয়ের মুহূর্ত নিয়ে কাজ করে না, বরং সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানো, রূপান্তরিত হওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিকেও বিশ্লেষণ করে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত, বা পরিবেশগত—যে কোনো ধরনের সংকটেই এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বিশেষ করে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যখন একের পর এক ধাক্কা আসছে, যেমন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড-১৯ মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়, এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলন, তখন এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
সংকট সমাজবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হলো, যখন কোনো সমাজ তার 'স্বাভাবিক' অবস্থা হারায়, তখন তার সামাজিক প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে কাজ করে তা বোঝা। এই বিষয়ে চার্লস পেরোর ১৯৮৪ সালের বিখ্যাত কাজ 'নরমাল অ্যাক্সিডেন্টস' একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পেরো যুক্তি দেন যে আধুনিক সমাজ, যা উচ্চ প্রযুক্তির অবকাঠামো এবং জটিল রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় কেবল সম্ভাব্যই নয়, বরং অনিবার্য। কারণ, এর ব্যর্থতা কেবল ব্যক্তিগত ভুলের কারণে ঘটে না, বরং ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত জটিলতার কারণেই ঘটে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, এই তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কীভাবে একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামোতেও হঠাৎ করে সামাজিক অসন্তোষের কারণে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে।
২০১০ ও ২০২০ এর দশকে, সমাজবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বকে আরও বিস্তৃত করেছেন, যেখানে তারা স্থিতিস্থাপকতা—অর্থাৎ, কোনো সমাজ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ধাক্কা সামলে ওঠার, মানিয়ে নেওয়ার এবং নিজেকে পুনর্গঠনের ক্ষমতা—নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা দেখেছেন, সংকট প্রায়শই সমাজের বিদ্যমান বৈষম্যগুলোকে প্রকাশ করে। প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠী প্রায়ই সংকটের ফলে গভীর ক্ষতির শিকার হয় এবং তাদের পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াও অনেক ধীর হয়। যেমন, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় দেখা গেছে, কীভাবে স্বাস্থ্য সংকট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক অবিশ্বাসের সাথে মিশে সমাজে নতুন দুর্বলতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, সেখানে এই দুর্বলতাগুলো আরও বেশি প্রকট হয়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলন এই গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যোগ করেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই গণআন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে ছাত্র, শ্রমিক এবং মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ এক হয়ে ওঠে। সরকারের দমন-পীড়ন এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার ব্যর্থতা রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে সংকটে প্রবেশ করে তার একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে পেরোর তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায়: শাসক দলের ক্ষমতা কাঠামো ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত ও সংযুক্ত, যা কোনো একটি জায়গায় ধাক্কা লাগলে পুরো ব্যবস্থার পতন ঘটাতে পারে।