
খাদ্যনিরাপত্তার খুঁটিনাটি
কফিনে শেষ পেরেক
খাদ্যবঞ্চনার শেষ ধাপের নাম দুর্ভিক্ষ, যা খাদ্যাভাবের কফিনে শেষ পেরেক। এখন থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে (১৮৪০’র কথা) এমন এক ভয়াল দুর্ভিক্ষ আয়ারল্যান্ড নামে একটি দেশকে গ্রাস করেছিল । ‘গোলআলু দুর্ভিক্ষ’ বা পটেটো ফেমিন বলে খ্যাত ওই মহামারিতে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল দেশটি । কোনো দুর্ভিক্ষে এত মানুষ মারা গেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। শোনা যায় যে, এখনো আইরিশ জনসংখ্যা ভয়াবহ সেই দুর্ভিক্ষ-পূর্ব ১৮৪৫ সালের জনসংখ্যার চাইতে কম । একসময় চীন, ভারত, ইথোপিয়া এমনকি বাংলাদেশকেও দুর্ভিক্ষের ছায়া তাড়া করতো। সত্যি, তবে আজকাল পৃথিবীর কোথাও দুর্ভিক্ষের কথা খুব একটা শোনা যায় না এমনকি এই উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশেও। আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গরিবদের জন্য গৃহীত আয়বর্ধক কর্মসূচি যে মূলত দুর্ভিক্ষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে তা বলা বাহুল্য । তারপরও খাদ্যাভাবের কফিনে শেষ পেরেক বলে দুর্ভিক্ষের ওপর একটু ধারণা থাকা দরকার ।
জর্জ বার্নাড শ’র ম্যান অ্যান্ড সুপার ম্যান থেকে একটা সংলাপ উদ্ধৃত করা যাক। মেলনি নামের এক ধনিক আইরিশ-আমেরিকান ১৮৪০’র দুর্ভিক্ষকে দুর্ভিক্ষ বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ এবং তিনি তার পুত্রবধূ ভায়োলেটকে বলছেন ০% ‘৪৭‘র কালো সময়টিতে আমার বাবা খাদ্যাভাবে মারা গেছেন।’ ‘তার মানে দুর্ভিক্ষে?’-ভায়োলেটের প্রশ্ন। ‘না, অনাহারে। যখন একটা দেশ খাদ্যপূর্ণ ও তা রপ্তানি করছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না’-মেলনি উত্তর দিলেন। খাদ্য উদ্বৃত্ত সংক্রান্ত মেলনির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে তবে তার সরল মনে সম্ভবত বিশ্বাস ছিল যে, দেশের ভেতর উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকলে মানুষ কখনো না খেয়ে মারা যেতে পারে না- খাদ্য উদ্বৃত্ত মানে দুর্ভিক্ষের জন্য দরজা বন্ধ। কিন্তু সেক্সপিয়রের ‘হেমলেট’ নাটকে হেমলেটের সেই সালংকার মন্তব্য-‘স্বর্গ ও মর্ত্যে এমন আরো অনেক কিছু আছে হোরেশিও যা তোমার দর্শনের কল্পনার বাইরে’- মনে করিয়ে দেয় যে, সেই সময়টিতে মেলনির চিন্তার বাইরে অনেক কিছুই ঘটে থাকতে পারে, যা তিনি নিজেও হয়তো জানতেন না। আসলে রূঢ় বাস্তবতা এই যে, পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্য ঘাটতি নয়, বরং খাদ্য ক্রয়ে মানুষের অর্থের ঘাটতি কিংবা ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাওয়া। সুতরাং, চলমান ডিসকোর্সে যে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক তা হলো কী কী উপাদানের ওপর খাদ্যের অধিকার নির্ভর করে?
খাদ্যনিরাপত্তার স্তম্ভ
আধুনিক বিশ্বে ক্ষুধা দূর করতে চাইলে প্রথমেই প্রয়োজন দুর্ভিক্ষের বিস্তৃত কারণ খুঁজে বের করা। শুধু খাদ্য ও জনসংখ্যার যান্ত্রিক ভারসাম্যের নিরিখে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রিকতা হচ্ছে একজন মানুষ নিজের উৎপাদন দিয়ে হোক (যেমন কৃষক) অথবা বাজার থেকে ক্রয় করে হোক (যেমন চাকরিজীবী) একটা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কতটুকু স্বাধীন। মনে রাখতে হবে যে, সরবরাহের প্রাচুর্য সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি অনাহারে থাকতে বাধ্য হতে পারে যদি বাজার থেকে খাদ্য ক্রয়ে তার সামর্থ্য না থাকে অথবা সামর্থ্য হ্রাস পায়। যে কোনো কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যেমন আয় না থাকা কিংবা উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে ব্যর্থ হওয়া। অন্যদিকে, খাদ্য ঘাটতির মুখেও তেমন অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয় যদি খাদ্য আমদানি করে কিংবা ভাগাভাগি ভোগ করে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
খাদ্যের ওপর একটা পরিবারের স্বত্বাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট ( অন্য অর্থে খাদ্যনিরাপত্তা) নির্ভর করে বেশ ক’টি উপাদানের ওপর । প্রথমত, পরিবারটির নিয়ন্ত্রণে থাকা এমনতরো সম্পদসমষ্টি যার বাজারে দাম আছে এবং যা বাজারে বিনিময় করে খাদ্য ক্রয় করা যায়। এই সম্পদ আবার বহুবিধ হতে পারে মানব সমাজের বৃহৎ অংশের একমাত্র সম্পদ হচ্ছে শ্রমশক্তি বা লেবার পাওয়ার যেখানে দৈহিক শ্রমবাজারে বিক্রি করে দু’মুঠো খাবার পেটে দেওয়ার অবকাশ খুঁজে পায় আর এমনিভাবে শ্রম, জমি ও অন্যান্য সম্পদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ব্যক্তি বা খানার খাদ্য স্বত্বাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট।
দ্বিতীয়ত, একটা খানার খাদ্যে কতটুকু অধিকার থাকবে তা উৎপাদন সম্ভাবনা ও তার ব্যবহার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই আসে প্রযুক্তির কথা যা প্রাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়। এবং সবশেষে বিনিময় অবস্থার ওপরও খাদ্যঅধিকার নির্ভর করে যেমন, দ্রব্য বেচাকেনা ও মূল্য নির্ধারণ। অর্থাৎ, কী হারে খাদ্যদ্রব্যের দামের বিপরীতে মজুরি বাড়ছে তার ওপর স্বত্বাধিকার নির্ভরশীল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- খাদ্য নিরাপত্তা