
উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে ঠিক কী করেছিলেন পাইলট তৌকির
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মিশনটা ছিল এ রকম যে সে রানওয়ের ওপর ১৫ থেকে ২০ মিনিট ম্যাক্সিমাম ফ্লাই করবে। ছোট্ট একটা মিশন। যেহেতু এটা ছিল তার প্রথম সলো বা একক ফ্লাইট।
সকালবেলা সে কিন্তু একটা চেক রাইডে গেছে। একটা মিশন করেছে। এটা কে নিয়েছে? এটা তার কমান্ডিং অফিসার নিয়েছে। এটা একটা পরীক্ষার মতো। যখন দেখা গেছে তৌকির ফিট ছিল, তখন তাকে সলো ট্রিপে পাঠানো হয়েছে।
কমান্ডিং অফিসার কী করে? সে নিজে যেখান থেকে টেক অফ করবে ওইটার পাশে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের পাশে একটা মোবাইল হাট, একটা ভ্যানের মতো আছে সেখানে সেম রেডিও ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে একজন পাইলট সব সময় থাকে। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কমান্ডিং অফিসার নিজেই চলে যায় এবং সে সেখানে ছিল। তার কাছে রেডিও থাকে, ও সবকিছু শুনছে। ইচ্ছা করলে কথাও বলতে পারে। তো সেভাবে সে টেক অফ করে গেছে।
এই মিশনটা এ রকম যে ওখান থেকে দেখা যায়। পুরোটা সময়ই সে ভিজিবল (দৃশ্যমান) ছিল। তৌকিরকে পুরোটা সময়ই দেখা গেছে। তার কমান্ডিং অফিসার নিজের চোখে দেখছে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার দেখছে। সে পাইলট না হোক, অফিসার কমান্ডার নিজে তো পাইলট। সেই তাকে ক্লিয়ার করছে। সে দেখছে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ফ্লাইংয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নাই। প্রথম একটা রাউন্ড করল, দ্বিতীয় একটা রাউন্ড করল। তারপরে তৃতীয় রাউন্ড করে ল্যান্ড করতে আসবে, এতটুকুই। এমন সময়, অর্থাৎ তৃতীয় রাউন্ডের সময় কমান্ডিং অফিসার খেয়াল করল, তৌকির যখন উত্তরা বা টঙ্গীর দিক থেকে ঘুরে আসে। এদিকে, টেক অফ করেছে নিকুঞ্জের দিকে, ল্যান্ড করবে ওইদিক থেকে এসে। ও যখন আসছে ল্যান্ড করার কথা না, ফ্লাই করার কথা। সে যখন তিন-চার কিলোমিটার দূরে তখন কমান্ডিং অফিসার দেখল তৌকির মনে হয় হাইট লুজ করছে। এটা কিন্তু বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায়। দেখে মনে হলো তার (তৌকিরের) হাইট পড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তো বিমান ১ হাজার ৫০০ ফিট হাইটে ছিল। ১০ সেকেন্ডে পার কিলোমিটার যায়। আমাদের জন্য এটা কোনো স্পিড না। আমরা তো সুপারসনিক স্পিডেও ফ্লাই করি। সে আসছে, খুব লোয়ার সাইডের স্পিডে।
তো সে আসছে আর কমান্ডিং অফিসার দেখছে, আরে প্লেনটা তো আস্তে আস্তে নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু ওর তো নামার কথা না; ওর তো একই হাইটে যাওয়ার কথা। তখন কমান্ডিং অফিসার তৌকিরকে কল দিয়ে বলল, ‘যে চেক ইয়োর হাইট।’ ‘চেক ইয়োর হাইট’ বলার পরে ‘রজার’ আমরা বলি ‘কপিড’। তখন কমান্ডিং অফিসার ভেবেছে যে তৌকিরের বিমান বোধ হয় ভুলক্রমে নেমে গেছে। ১ হাজার ৫০০ ফিটের জায়গায় ১২০০-১৩০০ ফিটে নেমে গেছে। পরে তিনি দেখলেন যে আরে বিমান তো ওপরে উঠছে না, ক্রমাগত নিচে নামছে। তখন তার মনে হলো যে তৌকিরের বিমান তো খুব দ্রুত নামছে। তখন কমান্ডিং অফিসার দুবার তৌকিরকে বলছে, ‘ইজেক্ট ইজেক্ট’। ইজেক্ট হলো প্রতিটা এয়ারক্রাফটে একটা ইজেকশন সিট থাকে। পাইলট ইচ্ছা করলে এক মুহূর্তে ইজেক্ট করে বের হয়ে যেতে পারে। এটা এক সেকেন্ডের মধ্যে পাইলট বের হয়ে যেতে পারে।
আমাদের ট্রেনিংটা এ রকম—পাইলট তখনই ইজেক্ট করে, যখন সে মনে করে যে সে এই প্লেনটাকে আর সেফলি ল্যান্ড করতে পারবে না। যখন বিমান ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে বা পাইলট মারা যাচ্ছে, তখন পাইলট যে কাজটা করে তা হলো, ইজেক্ট। যখন কমান্ডিং অফিসার দেখল যে বিমানটা ডেঞ্জারাস নিচে নেমে গেছে, তখন ফাইনাল কমান্ড সে নিজে করে বলেছে, ইজেক্ট। দুইবার বলেছে ইজেক্ট, ইজেক্ট। কিন্তু ও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। তার মানে, পাইলট তখন ব্যস্ত ছিল বিমান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এবং এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আমার জীবনেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। আমি বিমানের কন্ট্রোল নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। তারপরে যখন দেখলাম চারদিকে ডাকাডাকি হচ্ছে, তখন উত্তর দিয়েছি। যখন আমি বিমানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছি, তখন কমান্ডিং অফিসারের মেসেজের উত্তর দিয়েছি। যদি আমি ক্রাশ করে যেতাম, তাহলে তো উত্তর দিতে পারতাম না, কেউ জানত না কী ঘটেছিল ওই সময়!
তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, যান্ত্রিকত্রুটির কারণে উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর এই দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে পাইলটের কোনো গাফিলতি ছিল না বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। অনেকেই না জেনে বলেছেন বিমান অনেক পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ।
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- বিমান বিধ্বস্ত
- পাইলট