
হিজড়াদের প্রতিরোধ আমাদের মুখে চপেটাঘাত
বরিশাল শহরের রসুলপুর চরে এক কিশোরীকে সম্ভাব্য ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করেন হিজড়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন মানুষ। ঘটনাটি ঘটেছে সপ্তাহখানেক আগে, গত ১ জুলাই। মেয়েটির চিৎকার শুনে হিজড়ারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং অভিযুক্তকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন—জানান তাদের নেত্রী কাবরী হিজড়া।
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে কিছুটা আলোড়ন তুললেও মূলধারার গণমাধ্যমে তা এক ধরনের 'প্রতীকী সেন্সরশিপ' বা ‘নীরব উপেক্ষা’র শিকার হয়। অথচ যদি ঘটনাটি হতো ‘হিজড়াদের হাতে ছিনতাই’, ‘হিজড়াদের অত্যাচার’ বা ‘অপরাধী হিজড়া’—তবে তা হয়তো প্রথম পাতা দখল করে নিত।
সংবাদমাধ্যমে হিজড়াদের নিয়ে প্রকাশিত অনেক শিরোনামই আমাদের সমাজের লিঙ্গভীতি, ভেদবুদ্ধি এবং আধিপত্যবাদী মনোভাবের প্রতিচ্ছবি। যেমন: ‘রাজধানীতে হিজড়াদের উৎপাত বাড়ছে’, ‘হিজড়ারা দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে’, ‘হিজড়ারা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে’—এই ধরনের শব্দ ও বাক্যচিত্র এক ভয়ের বৃত্ত তৈরি করে।
‘উৎপাত’, ‘ভয়ঙ্কর’, ‘উগ্র’—এই শব্দগুলো যেন কৌশলে হিজড়া সম্প্রদায়কে অপরাধী বা সমাজবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।
কিন্তু আমরা কি কখনও থেমে ভেবেছি—তাদের এই তথাকথিত ‘উগ্রতা’ আসলে কী?
এটি আসলে এক দীর্ঘকালীন রাষ্ট্রীয় অবহেলা, সামাজিক নিপীড়ন এবং মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া—একধরনের আত্মরক্ষার ভাষা, নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মরিয়া প্রয়াস।
যখন আইন, সমাজ, ধর্ম এবং পরিবার সবাই মিলে কোনো মানুষকে গলা টিপে ধরতে থাকে, তখন তার কণ্ঠস্বর একটু বেশি জোরে বের হয়ে আসতেই পারে। সেটি ‘উগ্রতা’ নয়, বরং ‘বেঁচে থাকার আর্তনাদ’।
এই ভাষা শুধু হিজড়াদের অপমান করে না, জনমনে ভয় ও ঘৃণার বীজ বপন করে—যার ফলে তাদের প্রতি সহিংসতা যেন স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে ওঠে।
তারা যখন ধর্ষণ রোধে সাহস দেখায়, তখন তা খবর হয় না; কিন্তু রাস্তায় একটু উচ্চস্বরে কথা বললেই তাদের ‘উৎপাত’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এই দ্বিমুখী সংবাদ-নৈতিকতা আমাদের সমাজে বৈষম্য ও বিদ্বেষকে আরও গভীর করে তোলে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হিজড়াদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক মন্তব্যের ছড়াছড়ি। ‘মূর্খ’, ‘অমানুষ’—এই শব্দগুলো শুধু গালিগালাজ নয়, বরং মানুষ-হিসেবে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে, এক নির্মম ডিহিউম্যানাইজেশনের প্রতিফলন ঘটায়।
‘হিজড়ারা উগ্র’, ‘তাদের আচরণ ভয়ঙ্কর’, ‘তারা রাস্তায় টাকা আদায় করে’—এই অভিযোগগুলো যেন এক প্যাকেজে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখি—এই আচরণগুলো কি আমরা মানসিক আঘাত, সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে দেখেছি?
রাস্তায় কি শুধু হিজড়ারাই সহিংসতা ছড়ায়? ছিনতাই, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, খুন—এই অপরাধগুলো কি কেবলমাত্র হিজড়ারা করে?
কোনো হিজড়া কি কখনও কোনো নারীকে রাস্তায় ধর্ষণ করেছেন, হত্যায় অংশ নিয়েছেন, সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রে জড়িয়েছেন—এই প্রশ্নগুলো আমরা করতে ভয় পাই, কারণ উত্তরটা আমাদের আরামদায়ক সামাজিক বৃত্তিকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- লিঙ্গ বৈষম্য
- হিজড়া