
গতবারের তুলনায় এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় ১৩ লাখ পশু কম কোরবানি হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ৩৩ লাখ ১০ হাজারের বেশি কোরবানির পশু অবিক্রীত রয়েছে।
এই চিত্র নিশ্চিতভাবেই আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। এবার এত পশু কেন অবিক্রীত থেকে গেল, তার ব্যাখ্যা হিসেবে কাউকে কাউকে বলতে শুনছি, ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অনেকেই কোরবানি দেননি। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে গত ১০ মাসে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা হাটবাজার, সেতু থেকে শুরু করে জলমহাল, বালুমহাল, টেন্ডারবাজি, ফুটপাত—সবকিছুর দখল চলে গেছে বিএনপির নেতা–কর্মীদের কাছে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির নেতা–কর্মীসহ গণ অধিকার পরিষদের অনেক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি এবং সরকারি কাজে ভাগ–বাঁটোয়ারা, তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের অর্থনৈতিক ভিত্তি আগে থেকেই শক্তিশালী। গত ১০ মাসে তাদের কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নেই পরিচালিত হয়েছে। ফলে রাজনীতিকে আশ্রয় করে নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণি দৃশ্যমানভাবেই উপস্থিত। এরপরও কেন এ বছর এত পশু অবিক্রীত থাকল?
এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অর্থনীতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। শেখ হাসিনা যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত একটি কুলীন গোষ্ঠীই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল। নাগরিকেরা সেখানে ছিলেন নিছক কর-ভ্যাট-রাজস্বের জোগানদার। ফলে একদিকে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সম্পদের বড় অংশটা পুঞ্জিভূত হয়েছে আর অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন নিঃসন্দেহে অনন্য এক অর্জন। সব শ্রেণি–পেশার মানুষ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। কিন্তু অভ্যুত্থান বিশাল জনপ্রত্যাশা তৈরি করেছিল তার একটা বড় জায়গা ছিল, সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন যে তাঁদের ঘাড়ের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা ক্রোনিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আসবে। সরকারি সেবা তাঁরা বিনা ঘুষে, বিনা হয়রানিতে পাবেন। পদে পদে চাঁদা দিয়ে, নেতা, পাতিনেতা বা উপনেতাদের খাজনা দিয়ে তাঁদের টিকে থাকার লাইসেন্স কিনতে হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স ১০ মাস পেরিয়েছে। সরকারপ্রধানের কাছ থেকে নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়সীমা জানা গেছে, তাতে সরকারের কার্যকাল অর্ধেকটা পেরিয়েছে। কিন্তু এ সময়টাতে বন্দোবস্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলকতা, বহুত্ববাদ বা সংস্কারের মতো কঠিন শব্দগুলো শোনা গেলেও যেসব পরিবর্তন হলে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের কাছে সরাসরি ভোগান্তি, হয়রানি, ঘুষ ছাড়া সেবা পেতে পারেন, সেই উদ্যোগগুলো মোটেই দৃশ্যমান নেই।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চাপে আছে অর্থনীতি। আর অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকটটা হলো অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই। নিম্ন আয়ের মানুষেরা বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) যে ২১ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন, তার ৮৫ শতাংশ নারী। কৃষিতে আদৌ কোনো অভিভাবক আছে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ফলে পেঁয়াজ, আলু, শীতের সবজি, ধান থেকে শুরু করে গরমের সবজি পটোল—লোকসানের বোঝা দীর্ঘায়িতই হচ্ছে। সর্বস্বান্ত চাষিদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও বেড়েছে।
অর্থনীতির এই অনিশ্চয়তার কারণ হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এমন পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগ তো দূরে থাক, দেশি বিনিয়োগকারীরাই তাঁদের পকেট থেকে টাকা বের করেন না। এরপর আবার ঢাকার বাইরে পুলিশ প্রশাসন কার্যত প্রায় নিষ্ক্রিয়। মবতন্ত্রও আছে। সব মিলিয়ে এখন অর্থনীতি বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থানের পক্ষে নয়।
বিগত সরকার উন্নয়নের ফাঁপানো গল্প দিয়ে চাপা দিতে চেয়েছিল দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর কর্মসংস্থানহীনতার রূঢ় বাস্তবতাকে। জুলাই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগের জায়গা থেকে। এই অভ্যুত্থানে সমাজের আর যে তরুণেরা নেমে এসেছিলেন, সরকারি চাকরির সঙ্গে তাঁদের বিন্দুমাত্র সম্পর্কও ছিল না। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে চরম অনিশ্চয়তা, সেই বোধ থেকেই তাঁরা নেমে এসেছিলেন, বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশেষ সুবিধা
- সরকারি চাকরিজীবী