বর্তমান বিশ্বে চলচ্চিত্র দেখার মূলত তিনটি বৈধ উপায় রয়েছে—প্রেক্ষাগৃহ, ওটিটি প্লাটফর্ম ও টেলিভিশন। বাংলাদেশের মানুষও এই তিন বৃত্তের বাসিন্দা হয়েছে বহুদিন হলো। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো প্রথমে দেখানো হচ্ছে সিনেমাহলে, এরপর সেসব ছবি যাচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্ম ও পর্যায়ক্রমে টেলিভিশনে। এখন প্রশ্ন হলো চলচ্চিত্র দেখার জন্য এই তিন মাধ্যমের মধ্যে কোনটিকে দর্শক বেশি পছন্দ করছে, বা উপযোগী মনে করছে?
সারা দুনিয়ার সাথে তুলনা করলে হবে না, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিঞ্চিত ভিন্ন। কারণ যত দিন যাচ্ছে ঢাকা ততই ‘নরকে’ পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে মানুষ স্বাভাবিক ও জরুরি কাজটিই করতে পারে না ঠিক সময়ে। কারণ ঢাকা এখন ‘আন্দোলন ও অবরোধের নগরী’। যেকোনো সময়ে যেকোনো চৌরাস্তা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে, প্রশাসন অসহায়।
মানুষ তারচেয়েও বেশি অসহায় ও দুর্ভাগা। যেখানে মানুষ তার অতি জরুরি কাজই করতে পারছে না যথা সময়ের মধ্যে, সেখানে কি সে দুই আড়াই ঘণ্টার চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যাবে? যানজটের কারণে অতিরিক্ত আরও তিন ঘণ্টা খরচ করে? পুরো একটা বেলাই তো নাই হয়ে গেল তাহলে। সমাধান হতে পারে মেট্রোরেল।
প্রথম কথা, সেটি তো কেবল উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে, তাছাড়া, সেখানেও ইদানীং দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হচ্ছে। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে টিকিট ব্যবস্থাপনা আর শুরুর দিককার মতো কাজ করছে না। বলা যেতে পারে, যে লাউ সেই কদু। যেহেতু প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখা শুধুমাত্র দর্শকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, তাই বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখার আগ্রহে ভাটা পড়েছে।
ঈদ, পূজা বা যেকোনো উৎসবের সময়টা শুধু রাজধানী ঢাকা নিঃশ্বাস নিতে পারে। তাই মানুষও বিনোদনের জন্য সিনেমাহলে যায় এবং এই সময়টাতে, উৎসবভাতা পাওয়াতে, লোকজনের হাতে কিছুটা অর্থ থাকে বিনোদনের পেছনে খরচ করার জন্য। নয় তো দ্রব্যমূল্যের যা অবস্থা, কষ্ট করে উপার্জিত টাকা তারা সহজে সিনেমা দেখার কাজে ব্যয় করতে চায় না।
মূল কথা, উৎসবে অর্থ ও রাস্তাঘাট দুটোর অবস্থাই ভালো থাকে। তাই মানুষ ছবি দেখে। বাংলাদেশের দর্শককে কিন্তু একটা বিষয়ে বাহবা দিতেই হয়, চলচ্চিত্রের গল্প মোটামুটি ধরনের হলে, একটু গিমিক থাকলে, তারা সিঙ্গেল ও মাল্টিস্ক্রিনে ভিড় করে।
তবে সামনের দিনগুলোয় এই প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা আরও কমে আসবে। উৎসবকেন্দ্রিক দেশি চলচ্চিত্র ও হলিউড থেকে আমদানিকৃত ‘টেন্টপোল ফিল্ম’ ছাড়া সিঙ্গেল ও মাল্টিস্ক্রিনের কোনো গতি নেই। টেন্টপোল ফিল্ম বলতে বড় বাজেট, বড় তারকা, সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি, জনগণের মনে আগ্রহ জাগানিয়া ছবি।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শাকিব খান ছাড়া বড় কোনো তারকা নেই, আর তিনি উৎসব ছাড়া ছবি মুক্তি দেন না। কারণ উনিও বোঝেন বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও যানজট পরিস্থিতি। কাজেই বছরের অন্য সময়গুলো ভরসা ওই হলিউড। মনে রাখা প্রয়োজন, হলিউড কেবল মাল্টিস্ক্রিনেই সমাদৃত। হলিউডের অবস্থাও যে ভালো, তা নয়।
সুপারহিরো দিয়ে আর কত? সেটি দিয়ে এখন আর মানুষকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না তারা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে পরিচালক এনে নতুন ধরনের, নতুন গল্পের ছবি বানানোর চেষ্টা করছে হলিউড। তাতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক বং জুন-হো (Bong Joon Ho)-কে দিয়ে ‘মাইকি সেভেনটিন (Mickey 17)’ বানালো, খুব কি ব্যবসা করেছে? করেনি।
অপরদিকে, যে টেলিভিশন একসময় প্রেক্ষাগৃহের হুমকি হয়ে উঠেছিল, সেই টিভি এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ব্যাপক কোণঠাসা হয়ে আছে। বর্তমানে খেলাধুলা ও ঘটনা-দুর্ঘটনার লাইভ প্রচার করা ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব নেই টেলিভিশনের। কারণ গতানুগতিক টিভি চ্যানেলগুলোর কন্টেন্ট মানুষ যতটা না ঘরে রাখা টিভিতে দেখছে, তারচেয়ে বেশি দেখছে ইউটিউব ও ফেসবুকে।