
চট্টগ্রাম বন্দর কার হাতে?
গণঅভ্যুত্থানের আগে এবং পরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে, এটাই গণমানুষের প্রত্যাশা। অর্থনৈতিক কাঠামো বা পাল্টাতে গেলে, বিপ্লব দরকার হয়। যেহেতু ২৪ বিপ্লব নয়, অভ্যুত্থান হয়েছে তাই রাষ্ট্র কাঠামো পাল্টে যাবে এমন প্রত্যাশা কেউ করেনি। বরং লড়াইটা ছিল গণতন্ত্রের জন্য, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে। তাই বিগত সরকারের পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর দুর্নীতি, দুঃশাসন বন্ধ এবং সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের বিষয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নানামুখী সংস্কার ও নির্বাচন কবে হবে এটাই হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু। কিন্তু এসব ইস্যু ছাপিয়ে এবার বিতর্ক আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে ‘চট্টগ্রাম বন্দর’। বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হবে কী হবে না, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। রাজনৈতিক দল থেকে সাধারণ মানুষ কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন, প্রতিবাদ করছেন। বাংলাদেশের তিন দিক ভারত দিয়ে ঘেরা আর একদিকে একটুখানি সমুদ্র। যে দেশের সীমানায় সমুদ্র নেই, সেই দেশ খুবই অভাগা। কিন্তু সমুদ্র থেকেও যদি তার নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে সে দেশকে বলা হবে দুর্ভাগা। পৃথিবীতে এমন দেশের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ফলে সমুদ্র এবং তার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি হয় এই বন্দর দিয়ে। আর এই বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি। দেশের মোট কনটেইনার পণ্য ওঠানামার ৫৫ শতাংশই হয় এনসিটি দিয়ে। পণ্য ওঠানামার আধুনিক সব উপকরণ ও যন্ত্রপাতি রয়েছে এই টার্মিনালে। এবং এ থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে বন্দর কর্র্তৃপক্ষ।
ফলে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এনসিটি। এই টার্মিনাল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদ হয়েছিল তখন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেই ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিচ্ছে। বিশে^র পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরে সরব বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা। আন্দোলন-বিক্ষোভও করছেন তারা। জানা গেছে, প্রতিবাদ ও সমালোচনার পরও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা ও টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে উল্লেখ করা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক অপারেটর কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে (আরএসজেটিআই) দেওয়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিটিসি) অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে এই টার্মিনালে আমদানি পণ্য নিয়ে ভিড়তে শুরু করেছে বিদেশি জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং লালদিয়ার চরও বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় সরকার। এই বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। এ জন্য বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এর সক্ষমতা বাড়ানোরও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বন্দর ঘিরে মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। যেসব কোম্পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৬০ থেকে ৯০টি বন্দর হ্যান্ডলিং করছে, তাদের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চায় সরকার। প্রেস সচিব আরও বলেন, তরুণদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হলে শুধু দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য নয়; পুরো রিজিওনের ৩০-৪০ কোটি লোক এর সুফল ভোগ করবে। চট্টগ্রামের লালদিয়া, বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ পুরো অঞ্চলটাই বন্দরের উপযোগী। তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশের টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা ১ দশমিক ২৭ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট দীর্ঘ) কনটেইনার। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা ৭৮ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএস-এ নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ ছয় গুণ বাড়ানো। বাংলাদেশকে ইকোনমিক হাব, ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করতে হলে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিই হচ্ছে এক নম্বর পূর্বশর্ত।
দেশের অর্থনীতির আলোচনায় এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটাও তো ভাবতে হবে আমাদের বাস্তব অবস্থা এবং প্রয়োজন কী, ভবিষ্যতের ঝুঁকিগুলো কেমন হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল রয়েছে। এগুলো হলো চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। এ ছাড়াও সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ড (এসসিওয়াই), ওভার ফ্লো ইয়ার্ড, জেনারেল কার্গো বার্থসহ (জেসিবি) বেশকিছু ইয়ার্ড রয়েছে। যেখানে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ছাড়াও বাল্ক কার্গোও খালাস হয়ে থাকে। সিসিটি ও এনসিটি সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনা করছে। পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৌদির আরএসজেটিআইকে। বে-টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর বিদেশি বিনিয়োগে চালু করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও বিদেশি বিনিয়োগে হচ্ছে।
একটু অতীতের দিকে চোখ ফেরানো যাক! ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর স্টিভেডর সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ) নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ১৯৮ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে বামপন্থি দলগুলো, চট্টগ্রাম বন্দরের ২২টি শ্রমিক সংগঠন, তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। দাবি উঠেছিল, বন্দরের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিশেষত, এ দেশে একটিই মাত্র সমুদ্রবন্দর সেই দেশের জন্য। আন্দোলনের মুখে আদালতে ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর, সেই সেই চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। বন্দরের মূল আয়ের ৬০ ভাগ আসে এই টার্মিনাল থেকে। এ টার্মিনালের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এই টার্মিনালের উৎপাদনশীলতা অনেকগুণ বেড়েছে। যার ফলে ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই একটি টার্মিনালেই ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। বন্দর কর্র্তৃপক্ষের মতে, এই টার্মিনালে বর্তমানে যে পরিমাণ ইক্যুইপমেন্ট আছে তা দিয়ে আগামী ১৫ বছর বন্দরের কার্যক্রম চালানো যাবে। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও এর সঙ্গে জড়িত। তাই বন্দর নিয়ে আমরা যাই করি না কেন, তা ভেবেচিন্তে দেশের স্বার্থে করতে হবে। এখন নিউমুরিং টার্মিনালকে নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো, এটি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে পারে। টার্মিনালে স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় দ্রুতগতিতে কনটেইনার ওঠানো ও নামানো যায়। বন্দরের হিসাবে, গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ কনটেইনার বেশি ওঠানামা হয়েছে এই টার্মিনালে। বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া এখন বৈশ্বিক ট্রেন্ড বা প্রবণতা। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় বন্দর পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে পোর্টে বা টার্মিনালে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি, সেখানে বিনিয়োগ করা হয়, যাতে করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দিয়ে পোর্ট বা টার্মিনাল তৈরি করতে পারে। এরপর তারা সেটি পরিচালনা করে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিদেশিরা চলে গেলে বন্দর আবার দেশীয় মালিকানায় ফিরে আসবে। কিন্তু নিউমুরিং পুরোদমে চলমান একটি টার্মিনাল। ফলে এখানে বিদেশি বিনিয়োগ কেন প্রয়োজন, কোথায় প্রয়োজন এবং এর ফলে বন্দরের দক্ষতা কতটা বাড়বে সেটা নিয়ে আলোচনা ও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।