
ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন: সত্য যে কঠিন
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কয়েক দিন আগে একটি সভায় বলেছেন, দেশে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন) গঠন করা হবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য এটি খুবই প্রয়োজন। ভালো হতো যদি বাহাত্তর সালেই এ রকম একটি কমিশন গঠন করা হতো। তিনি বলেছেন, তাঁরা (অন্তর্বর্তী সরকার) খুবই পেশাদারত্বের সঙ্গে সবকিছু নিষ্পত্তি করতে চান। যারা গণহত্যার মতো, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করেছেন, তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি না। তাঁদের উপযুক্ত, যথেষ্ট পরিমাণ শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের করতে হবে। তাঁরা যে এই জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হলেও এই কমিশন গঠন করতে হবে।
রিকনসিলিয়েশনের প্রয়োজনীয়তার কথা জুলাই অভ্যুত্থানসংক্রান্ত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সত্যিই এ রকম একটি
কমিশন গঠন করলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর ওই কমিশন যদি সত্যিই কাজ করতে পারে, তাহলে তার ফলে আমাদের জাতীয় অর্জনও হতে পারে অমূল্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কমিশন গঠন করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার কথা স্মরণ করা হয়। কারণ, ১৯৯৫ সালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর নেতৃত্বে সেখানে যে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা হয়, তার অনুসৃত প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, বিধিবিধান সবই আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য বলে সারা পৃথিবীতে মান্যতা পেয়েছে। নিশ্চয়ই সেই কারণে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি এবং প্রধান বিচারপতিসহ একটি টিম দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করবে।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে এ ধরনের কমিশন-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় জানা-বোঝার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাই হচ্ছে উপযুক্ত দেশ। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। সব দেশকেই তা নিতে হয়। তার মধ্যে একটি হলো, কোন কালপর্বকে আমরা কমিশনের কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট করব। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিশনের বিবেচ্য কালপর্ব ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল। আমরা এ ক্ষেত্রে কী করব? আমরা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পর্বকে সুনির্দিষ্ট করতে পারি। ২০০৯ সাল থেকে করতে পারি। তার আগের কিংবা তারও পূর্ববর্তী কোনো সময়কে সুনির্দিষ্ট করারও সুযোগ আমাদের আছে। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় যেটি করতে হবে সেটি হলো—ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পুনর্মিলন বা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই কখন থেকে আমাদের জাতীয় অমিল বা অনৈক্য শুরু হলো, সেটাই হতে হবে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য।
এ প্রসঙ্গও আইন উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ১৯৭২ সালে এই কমিশন করলে বা তখন থেকে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তখন ভাবনার বিষয় হলো এখন কী করা প্রয়োজন। ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের জন্য কালপর্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা কি বাহাত্তর সালকে উপেক্ষা করতে পারব! যদি তা করি তাতে কি জাতীয় অনৈক্যের কারণ কিংবা সূচনা সম্পর্কে পূর্ণ সত্য উদ্ঘাটিত হবে! যদি না হয় তাহলে জাতীয় ঐক্য কিংবা পুনর্মিলন হবে কি? এগুলো হলো কমিশন গঠন এবং তা থেকে প্রকৃতই কিছু অর্জনের জন্য অপরিহার্য চিন্তার বিষয়।
আরেকটি বিষয় হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই কমিশন গঠন করেছিল সে দেশের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। তখন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম বিজয়ী হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সংসদ গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা তখন স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই সংসদে গঠিত কমিশনকেও সংঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ গ্রহণ করেনি। কমিশনের কাছে অনেকে সাক্ষ্য কিংবা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। বর্ণবাদবিরোধী হিসেবে খ্যাত এবং সম্মানিত পি ডব্লিউ বোথার মতো মান্যবর ব্যক্তিও কমিশনের সামনে উপস্থিত হওয়ার সমন অমান্য করেছিলেন। মুক্তি আন্দোলনের সদস্যরা সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যদিও কমিশনের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। পরে অবশ্য তাঁরা রাজি হন। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। তাঁরা এবং এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক সরকারের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকেরা কমিশনের কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন করেননি। এসব কথা উল্লেখ করার কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত (যদি গঠন করা হয়) কমিশনের কাজের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে, তা আগে থেকেই বিবেচনা করে দেখা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয় ঐক্য
- রাষ্ট্র সংস্কার