
দেশ আগে, না রাজনৈতিক দল?
শিষ্য তার পেটের ব্যথা নিরাময়ের জন্য গুরুর শরণাপন্ন হয়েছে। গুরু পরামর্শ দিলেন, তোমাকে এক হাজার একটা পরিবার থেকে চাল সংগ্রহ করে এক বছর ভাত রান্না করে খেতে হবে। গুরুর আদেশ শিরোধার্য। পেটের ব্যামো তো আগে নিরাময় হোক! কাঁধে ঝোলা নিয়ে শিষ্যের চাল সংগ্রহ ও ভাত রান্না করে খাওয়া শুরু হয়ে গেল। তিন বছরেও রোগ ভালো হলো না। শিষ্য ইতোমধ্যেই ভিক্ষাবৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামের সবাই ভিক্ষুক নাম দিয়েছে। আমাদের গ্রামের আবুবক্কা ভাইয়ের ধুয়োজারি গান ছোটবেলায় প্রায়ই শুনতে যেতাম। তিনি গাইতেন, ‘গুরু গুরু বলে ডাকি গুরু রসের গোলা-আ-আ, ওরে এমন দোয়া দিলে গুরু তুমি কাঁধে দিলে ঝোলা, আহা-আ-আ-আ’। আওয়ামী লীগ যে ভারতের গোলাম ও সেবাদাস ছিল, ক্ষমতায় বসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন সাহেবের সাত দফা চুক্তি ও শেখ মুজিবের ২৫ বছরের গোলামি চুক্তির আগে কেউ বুঝতেই পারেনি। গোলামি ও সেবাদাসীর কর্ম কাকে বলে গুরুকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবের শাসন ও শেখ হাসিনার শাসন বাস্তবে তা দেখিয়ে দিয়েছে। এ দেশের স্বাধীন অস্তিত্ব ও উন্নতির কাঁধে গুরু-শিষ্য ভিক্ষার ঝোলা তুলে দিয়েছেন। অধীন দাস ও করদ রাজ্যের মর্যাদা গুরু দিয়েছেন। আমাদের দেশে একদল গোলাম আছে, ‘দাদাবাবুদের’ পদলেহনে মহাতৃপ্তি পায়; ‘ঠাকুর বংশে দেহ-দানে স্বর্গসুখ’ অনুভব করে। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন ও বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক শাসন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার তুলনায় শতগুণ বিভীষিকাময়। এতদিনে ভাবুক বাংলাদেশিরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এদেশে ভারতের দখলদারিত্ব কায়েম হোক, এ দেশের সাধারণ সচেতন মানুষ আর চায় না।
চব্বিশের অর্ধ-সমাপ্ত বিপ্লব ছিল শেখ হাসিনার নির্ভেজাল গোলামি, দেশ লুটপাট ও করদ-রাজ্যের মর্যাদা অবসানের বিরুদ্ধে বিপ্লব ও স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য আত্মত্যাগ। কিন্তু এ অর্ধসমাপ্ত বিপ্লব তো সমাপ্ত হলো না, এর কী হবে? তাহলে হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী আধিপত্যবাদ থেকে কি এদেশ কখনো মুক্তি পাবে না? অন্য দলের কথা বাদ দিলাম, মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপি সরকার ভারত এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের বহিরাগত বলে পরিণামে ভূ-ভারত ছাড়তে বাধ্য করবে। এটা আমাদের শুধু স্বাধীনতা নয়, অস্তিত্বের সংকট। নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতার মসনদে বসবে, তারাও যদি জাতীয় অস্তিত্বের তুলনায় ক্ষমতাকে বড় করে দেখে, অতি প্রগতিশীল হয়ে ভারতীয় সুবিধার কাছে তারা যদি বিক্রি হয়ে যায়, তখন এদেশের স্বাধীন সত্ত্বার কী হবে! এই বোধ নব্বই শতাংশ মুসলমানের মধ্যে কি আছে? ‘জঙ্গিবাদী ও পাকিস্তানের পক্ষের শক্তি বনাম তথাকথিত প্রগতিশীল আদর্শ’ বিভাজনের ধুয়া তুলে ভারত কি ভবিষ্যতে আবারো এদেশ শাসন ও খবরদারি করতে পারবে? আমাদের একটু দূরদর্শী হওয়া দরকার।
স্বাধীন দেশের এ জনগোষ্ঠী নিজেদের ভুলে কৌটিল্য-চাণক্য বুদ্ধির কাছে পরাভূত হয়ে যদি হিংসাপরায়ণ ও শোষক ভারতকে আবার প্রশ্রয় দেয়, তখন পরিণামে কি একদিন এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হয়ে রোহিঙ্গাদের মতো পোঁটলা-কাঁথা-বালিশ মাথায় বেঁধে নিয়ে জমির আইল বেয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়? এ দেশের সবারই জানা উচিত, ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে এ দেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে যে ভুল করেছে, বিজেপি সরকার হলে কখনোই তা করত না, ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ এলে তারা এমন ভুল আর করবে না। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ওপর যে নিশ্চিত আস্থা ভারত সরকার রেখেছিল, এ দেশে এমন কোনো নির্ভেজাল গোলাম আর নেই। এছাড়া পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই, যে শক্তি মজ্জাগত মুসলিমবিদ্বেষ থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করতে পারে।
ভারতীয় আগ্রাসন ও হিন্দুত্ব-উপনিবেশবাদী শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত রাখার পরই দায়িত্ব চলে আসে এ জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ উন্নতি ও সমৃদ্ধি-স্বকীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে অস্তিত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধি। এখানেও এ দেশের রাজনৈতিক দলের গঠনমূলক অবদান অনস্বীকার্য। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীলতায় আপসহীন কোনো দলের নাম বিনা-দ্বিধায় ও নিরপেক্ষভাবে উচ্চারণ করা কঠিন, যারা বাংলাদেশি সব জাতিগোষ্ঠীকে একই সুতার ডোরে বেঁধে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দুচোখওয়ালা দলের সংখ্যা কম। কারও ডান চোখ কানা, কারও বা বাম চোখ। কেউ মুসলিমবিদ্বেষী; কেউবা অতিশয় রক্ষণশীল, কারও বা জনসমর্থন গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নেই। এরা নির্দিষ্ট কয়েকটা ইস্যুতেও এক হতে জানে না; দেশের মঙ্গলের তুলনায় দল ও দলবাজি এদের কাছে বড়।
রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থা ভাবতে গেলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বিগত ১৫ বছর ভারতকে সঙ্গে নিয়ে নির্ভেজাল আওয়ামীকরণের ফলে সরকারের প্রতিটা বিভাগের প্রতিটা পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ আওয়ামী-ভারতীয় এজেন্ট পদাধিষ্ঠিত হয়েছে। এরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে, প্রতিটা কাজে বাধা সৃষ্টি করছে, মনমতো কাজ করতে দিচ্ছে না, পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে শতেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত এহেন অবস্থায় সব রাজনৈতিক দল দেশরক্ষায় ও সম্মিলিত উন্নয়নে এগিয়ে আসুক, এটা সাধারণ মানুষ আশা করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক দল
- দেশপ্রেম