খাদ্যনিরাপত্তা এবং কৃষকের প্রতি ন্যায্যতা

বণিক বার্তা ড. সেলিম জাহান প্রকাশিত: ০৪ মে ২০২৫, ০৯:৩০

একটি দেশে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়টি কীভাবে দেখা দরকার? একটা সময়ে শুধু সামষ্টিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্যলভ্যতাকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার সমার্থক বলে মনে করা হতো। হিসাবটি ছিল সোজা-আংকিক নিয়ম মেনেই। একটি দেশের একজন মানুষের প্রতিদিনকার খাদ্য চাহিদা কত? সেই পরিমাণকে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করে দেশটির বার্ষিক মাথাপিছু খাদ্য চাহিদা জানা যেত। সেই সংখ্যাটিকে দেশটির মোট জনসংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই সামষ্টিক পর্যায়ে সে দেশটির খাদ্য চাহিদা বেরিয়ে আসত। তখন সেই প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হতো দেশটির মোট খাদ্য উৎপাদন কত? যদি দেখা যেত যে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদন ওই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিংবা সমান, তাহলে দেশটিকে ‘‌খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলা হতো। অন্যদিকে দেশটিতে খাদ্য উৎপাদন যদি প্রয়োজনের চেয়ে কম হতো তাহলে দেশটি খাদ্য আমদানি করে সে ঘাটতি মেটাতে পারত এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাকেই সে সময়ে মনে করা হতো যে দেশটিতে খাদ্যনিরাপত্তা আছে।


উৎপাদনভিত্তিক খাদ্যনিরাপত্তার এ ধারণার ভঙ্গুরতা পরিষ্কার বোঝা যায়, যখন আমরা বিশ্বের দুর্ভিক্ষের ইতিহাসের দিকে তাকাই। ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের যেসব ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাদ্যের পরিমাণের কোনো কমতি ছিল না। সামষ্টিকভাবে যে খাদ্যলভ্য ছিল, তা দিয়ে সে ভূখণ্ডের সব মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানো যেত—সেখানে বুভুক্ষার কোনো কারণ ছিল না। যেমন ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে উৎপাদনভিত্তিক খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধারণা খাদ্যনিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে না এবং খাদ্যনিরাপত্তার ধ্যানধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।


একটি দেশে খাদ্যনিরাপত্তার পর্যাপ্ত শর্ত হচ্ছে যে সে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যলভ্য হবে। এ লভ্যতার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে দুটো—এক. সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতে লভ্যখাদ্য শুধু পরিমাণগত দিক থেকে পর্যাপ্ত হলে চলবে না, তার বণ্টনকেও হতে হবে সুষম। দুই. প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনার ক্রয়ক্ষমতা প্রত্যেকের থাকতে হবে। বেশির ভাগ দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রেই সামষ্টিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সেখানে ছিল, কিন্তু ছিল না তার সুষম বণ্টন এবং না ছিল মানুষের প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা। অতএব খাদ্যনিরাপত্তা মানে উৎপাদনভিত্তিক খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা নয়, বরং খাদ্যনিরাপত্তা মানে হচ্ছে প্রয়োজনীয় পরিমাণগত দিক থেকে সামষ্টিক খাদ্য লভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে সে খাদ্যের সুষম বণ্টন এবং যথাযথ ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে খাদ্যে মানুষের প্রার্থিত লভ্যতা। সুতরাং খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়টি শুধু সামষ্টিক ধারণা নয়, এটি একটি ব্যষ্টিক ধারণাও বটে।



অনেকেই মনে করে থাকেন যে খাদ্যনিরাপত্তাই শেষ কথা নয়, সেখানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক পুষ্টিনিরাপত্তা। কারণ চূড়ান্ত বিচারে মানুষের স্বাস্থ্যগত কুশলের জন্য পুষ্টিনিরাপত্তা অনেক বেশি জরুরি। আসলে খাদ্যনিরাপত্তা হচ্ছে পুষ্টিনিরাপত্তার একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত। দরকারি ন্যূনতম ক্যালরি লভ্যতা একজন মানুষকে খাদ্যনিরাপদ করতে পারে, কিন্তু সেই মানুষটি পুষ্টিনিরাপদ নাও হতে পারেন। কারণ একটি পূর্বনির্ধারিত ক্যালরি বিবিধ খাদ্যের একটি সমন্বিত গুচ্ছ থেকে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সুষম পুষ্টিভিত্তিক খাবার সব গুচ্ছ থেকে পাওয়া যাবে না। যেমন শুধু শর্করাজাতীয় খাদ্য থেকেও প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে খাদ্যগুচ্ছ প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য হবে না এবং তা খাদ্যনিরাপত্তা বিধান করলেও পুষ্টিনিরাপত্তার সহায়ক হবে না।



একটি সমাজে খাদ্যনিরাপত্তা কে নিশ্চিত করে? একদিকে কৃষক এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র—কৃষক খাদ্যনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করে এবং রাষ্ট্র সে নিরাপত্তার জন্য আবশ্যিক সুষম বণ্টন এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত করে। যেহেতু কৃষক খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে, তাই এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের প্রতি ন্যায্যতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ ন্যায্যতার ব্যাপারটি দুদিক দিক থেকে বিবেচিত হওয়া দরকার। এক. খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে এবং দুই. কৃষকের নিজের পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে। খাদ্য উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের প্রতি ন্যায্যতা বিষয়ের তিনটি দিক আছে—অধিকারের ভিত্তিতে ভূমির মালিকানা; কৃষি ঋণ, বীজ, সার, সেচ সুবিধাসহ সুলভ মূল্যে কৃষি উপকরণের সরবরাহ এবং মধ্যস্বত্ববিহীন বাজারজাতের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ। যে কৃষক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে সারা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তার পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা বিধান করা কৃষকের প্রতি ন্যায্যতার একটি দিক। সেটা নিশ্চিত করার জন্য কৃষকের আয় সুনিশ্চিত করে তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সুমূল্য নিশ্চিত করা, ভোক্তা হিসেবে সুলভ মূল্যে কৃষক যাতে বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করা।


খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক দুটি স্তরেই রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা আছে। দেশে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারে—খাদ্যের সুষম বণ্টনের বলয়ে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। খাদ্যের সুষম বণ্টনের জন্য খাদ্য লভ্যতার প্রক্রিয়ার অন্তরায় দূর করার জন্য রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্যলভ্যতা নিশ্চিত করতে খাদ্য ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকার খোলাবাজারে খাদ্যসামগ্রী বিক্রির মাধ্যমে খাদ্য বণ্টনকে সুষম করতে পারে। অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অর্থনীতিতে কর্মনিয়োজন বৃদ্ধি করা যেতে পারে ও যথাযথ মজুরি নিশ্চিত করা যায়। খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সে ক্ষেত্রে দেশের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাণিজ্যনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে, সংশ্লিষ্ট খাদ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ার কাঠামোগত অন্তরায় দূরীকরণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনলে মানুষের কার্যকর ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাবে।



সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও