
‘নতুন উপসর্গ’ ও ‘পুরোনো রাজনীতি’: নির্বাচন কতদূর
রাজনীতিতে এখন অনেক নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। ধারণা করা যায়, আরও নতুনতর ঘটনা ঘটবে। একেকটি ঘটনা একেক রকম সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে হাজির হবে। আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচন তাতে বেশ দোল খাবে, তার ক্ষীণরেখাটি এখন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।
সর্বশেষ যে ঘটনাটি রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছে সেটা হচ্ছে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার প্রস্তাব এবং রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার উপায় নিয়ে আলোচনা। আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকা মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান যখন পরিষ্কার হচ্ছে, তখন বিএনপি এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর জন্য 'মানবিক করিডর' স্থাপনে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মর্মে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। তারও আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজ এলাকায় এক জনসভায় এ বিষয়ে মত প্রকাশ করতে যেয়ে বলেই ফেলেছেন—'আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না'।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও উৎকণ্ঠা
অন্যদিকে বহুল আলোচিত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো পাওয়া যায় নাই, এমনকি মাসও না। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দাবি করছে নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা বলছেন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের কথা। ফলে, বিএনপি ঠিক সন্তুষ্ট নয়। তারা ভাবছে, নির্বাচনই সমাধান অথচ সেই নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তালবাহানার শেষ নেই। বিএনপির যুক্তি খুব সুস্পষ্ট, নির্বাচনই খুলে দেবে সংস্কারের পথ। বিএনপির ব্যাখ্যা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ শাসনই হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল চাওয়া।
দেশের আরেক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর মন বোঝা দায়। পেন্ডুলামের দোলকের মতো দুলছে তার রাজনৈতিক ঘোষণা। কখনো তারা চাইছে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। কখনো বলছে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি, কখনো বলছে গণ-হত্যাকারীদের বিচার না করে নির্বাচন নয়। লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে জামায়াত নেতার কথায় যে নতুন সুর, তার বাজনাও ইঙ্গিতবাহী। ফলে, অতীতের মতো রাজনীতিতে জামায়াত তার বহুরূপী চেহারাটা কেমন করে যেন আজও জাগিয়ে রেখেছে সোৎসাহে, বিড়ম্বনা-নিপীড়ন-অত্যাচার সয়েও।
ছাত্র-জনতার দল ও সংশয়...
নির্বাচন নিয়ে কঠোর অবস্থানে গণ-অভ্যুত্থানের গর্ভে জেগে ওঠা ছাত্রজনতার দল এনসিপি। যদিও এখনো তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায় নাই, তবুও তাদের এক পা রাষ্ট্র ক্ষমতায়, আরেক পা রাজনীতির মাঠে। নতুন দলের নেতাদের অনেকের বাহারি ব্যয়বহুল জীবন ও নানাজনের নানারকম দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসছে।
ছাত্র-তরুণদের উদ্যোগে সরকার ও রাজনৈতিক দল গঠন—অনেকের মধ্যেই পরিবর্তনের সম্ভাবনার উৎসাহ তৈরি করেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতিতে তারা ইতিবাচক কিছু করবেন—এমন আশাও জোরেশোরে করা হয়েছিল। তবে সরকারি পদ এবং দলের দায়িত্বে থাকা কারও কারও কর্মকাণ্ডে সেই প্রত্যাশা দিনকে দিন কমছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে এই তরুণদের কারও কারও বিরুদ্ধে।
ফলে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার যে অংশ বিজয়ীর বেশে সামনে এসেছিল, তাদের অনেকেরই বিতর্কিত কর্মকাণ্ড জনমনে প্রত্যাশার চমকের পারদটাকে আর জাগিয়ে রাখতে পারছে কি না, সে সন্দেহও দেখা দিয়েছে।
নতুন দল গঠনের হিড়িক
এরকম একটা অনিশ্চিত, দোদুল্যমান অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নতুন দল গঠনের হিড়িক পড়ে গেছে। বিবিসি বাংলার খবর বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত গত আটমাসে অন্তত ২২টি রাজনৈতিক দল ও ও চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। যার মধ্যে ২০২৪ সালে ১১টি আর ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে আরও ১১টি দল গঠিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হয়েছে।
আত্মপ্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে আছে—নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) ও বাংলাদেশ জনতা পার্টি।
এত অল্প সময়ে এত নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে কেন? এটা কি স্বাভাবিক বিষয় না এর গর্ভে আছে কোনো নতুন অঘটনের প্রয়াস? এ বিষয়টি রাজনীতিতে অনেক ধরনের উদ্বেগ ও জটিলতার নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকের অভিমত।