
আরববিশ্বের নীরবতা গাজার গণহত্যাকে উসকে দিচ্ছে
গত বছরের অক্টোবর মাসে হামাসের তরফ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছিল, আরব দেশগুলো এবং পশ্চিমাদের নীরবতা ইসরায়েলকে গণহত্যায় উসকানি দিচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের বর্বরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন গাজার মানবিক বিপর্যয় নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ জানিয়ে হত্যা ও বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে ইসরায়েল গাজাকে ফিলিস্তিনি শূন্য করার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেছে। এর নেপথ্য কারণ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিন দিন। ইসরায়েলের এই বর্বরতার পেছনে সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক এখন গর্ত থেকে বের হয়ে এসেছে।
যারা এত দিন ধরে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের কথা বলে এসেছে, তারাই এখন গাজাকে ফিলিস্তিনি শূন্য করে সেখানে ‘রিভেরা’ (বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র) নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। গাজাবাসী কোথায় গিয়ে থাকবে তারও একটি সমাধান দিয়ে রেখেছে, আর সেটি হচ্ছে মিসর ও জর্দান, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব তাদের কথায় উঠবস করবে—এই বিষয়ে তাদের আস্থার কোনো অভাব নেই!
সারা বিশ্ব আজ বিক্ষুব্ধ। আর এই বিক্ষোভের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একটি দেশ কিভাবে আরেকটি দেশকে ধ্বংস করার মহাযজ্ঞে মত্ত থাকতে পারে, আধুনিকতার শিখরে এসে আজ গাজায় আমরা এই বাস্তবতা দেখছি প্রতিনিয়ত।
ইসরায়েলের বিজয়কে নিশ্চিত করতে এবং গাজা ধ্বংসের সব আয়োজন সম্পন্ন করতে প্রয়োজনে ইরানকেও ছাড় দেওয়া হবে না, ইসরায়েলের চিরবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেন এই প্রতিজ্ঞা! আর সে জন্য তারা ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ মালিকানাধীন দ্বীপ দিয়াগো গার্সিয়ায় অত্যাধুনিক রণতরি মোতায়েন করেছে। ইরানকে লক্ষ্য করে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে যেকোনো সময় সেখানে হামলা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এত কিছুর পরও নীরব আরববিশ্ব তথা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়। মাত্র ২৪ লাখ মানুষ অধ্যুষিত গাজা যেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম হারাম করে দিয়েছে! কেবল আরববিশ্বের কথাই বা বলছি কেন, জাতিসংঘ, পশ্চিমা অপরাপর দেশগুলো, নিরন্তর মানবাধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা উঠিয়ে বেড়ানো সংস্থাগুলো কিংবা চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোসহ কেউ আজ মানবিক এই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে না। নীরবে এই ধ্বংসলীলা উপভোগ করছে যেন!
এর কারণ কী এবং কেনই বা বিশ্বের একমাত্র ধর্মভিত্তিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) পর্যন্ত চুপ রয়েছে? এই সব কিছু আমাদের গভীরভাবে ভাবায়। অথচ ১৯৬৯ সালে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েল কর্তৃক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবসহ বড় বড় আরব রাষ্ট্রের উদ্যোগে এই সংস্থাটি গঠিত হয়, যারা পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় ওআইসির সদস্যসংখ্যা এখন ৫৭। সংখ্যায় বাড়লেও শক্তিতে এক দন্তবিহীন বাঘ ছাড়া আর কিছুই নয় এই সংস্থাটি। ট্রাম্পের গাজা খালি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ইসরায়েল যখন হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে, আরব লীগ এই অবস্থায় গত মাসের প্রথম দিকে মিসরের একটি পরিকল্পনাকে অনুমোদন করে, যা পরে ওআইসি কর্তৃকও অনুমোদিত হয়।
কী সেই পরিকল্পনা? খুব বেশি কিছু নয়, এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেবল এই পরিকল্পনায় গাজা খালি করার মার্কিন পরিকল্পনার জবাবে গাজা পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আর্থিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এত বড় একটি মানবিক বিপর্যয় চলছে, আরব দেশগুলোর নাকের ডগায় ইসরায়েল এই কাজটি করে যাচ্ছে, অথচ কিছুই করার নেই! পশ্চিমা দেশগুলো, যারা মানবাধিকারের কথা বলে সাড়া দুনিয়ায় সব সময় হৈচৈ ফেলে দেয়, তারাই বা কী করছে? সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ জানিয়েছেন যে তাঁর দেশ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তাতেই বা কী? এর আগেও ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যার মধ্যে চীন ও রাশিয়াও রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হলেও কেবল ইসরায়েলের অনিচ্ছায় এবং এর ফলে মার্কিন বিরোধিতায় জাতিসংঘের স্বীকৃতি মেলেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে ফিলিস্তিনের অধিকার নিয়ে চিন্তিত নয়, এমনটিও নয়। মূলত ওআইসি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্রই ছিল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে কেবল ফিলিস্তিনিদের নয়, আরববিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর জন্যও ইসরায়েলের হুমকি থেকে নিজেদের নিরাপদ এবং নিশ্চিন্ত রাখা। বাধা কেবল একটিই আর সেটি হচ্ছে গণতন্ত্রহীন রাজতান্ত্রিক আরববিশ্বের নেতাদের নিজেদের সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী সৌদি আরব। আরববিশ্বের ডিফ্যাক্টো নেতৃত্বদানকারী এই রাষ্ট্রটির কারণেই মূলত আরব ঐক্যের ভেতর বড় ধরনের চির ধরেছে। ফলে কাতার, কুয়েত ও আমিরাতের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর মার্কিন মুখাপেক্ষিতার দিকেই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর আগে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার মধ্য দিয়ে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সম্পৃক্ততা যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের মেয়াদে এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছিলেন। সৌদি তথা গোটা আরববিশ্বের নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য একমাত্র নিরাপত্তার নিশ্চয়তাদানকারী, এমনটি বছরের পর বছর ধরে জনগণের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন শাসকরা। অন্য কথায়, মার্কিন তথাকথিত নিরাপত্তাবলয়ের বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও এই মুহূর্তে এই রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর হাতে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে (বিনিয়োগ সম্পর্কিত) কেন্দ্র করে সৌদি আরবের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের আমলে সম্পর্কে চির ধরলেও গাজা বিষয় নিয়ে তাদের অবস্থান কেবল প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যার কারণ তারা ইরানের মতো সরাসরি নিজেদের মার্কিন লক্ষ্যবস্তু করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছে।