
রাজনীতির মেরুকরণ জটিল হচ্ছে
প্রবাদ আছে, ‘রাজনীতিতে এক সপ্তাহ একটা লম্বা সময়’। কয়েক সপ্তাহ আগেও যেসব জিনিস মনে হচ্ছিল সহজভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এখন ধীরে ধীরে সেগুলো জটিল হচ্ছে। রাজনীতিতে অনেক অংশীদার—সরকারে ও বাইরে, তাদের সবার ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন দিন দিন রাজনীতির মেরুকরণ আরও জটিল হচ্ছে।
পাঁচ বছর বনাম এক বছর
অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে, এ বিতর্ক কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা আড়ালে চলছেই। পেন্ডুলাম দুলছে এক বছর ও পাঁচ বছরের মধ্যে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চলতি বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। তবে অনেকেই মনে করেন, এই সময়সীমার একটা বড় শর্ত হলো, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রশ্নে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একমত হবে। যদি তারা একমত না হতে পারে, তাহলে কী হবে?
মাঝেমধ্যে পাঁচ বছরের দিকে পেন্ডুলাম দুলছে। সেটাও আসছে সরকারের কাছের লোকদের থেকে, জুলাই আন্দোলনে জড়িত নেতাদের থেকে এবং সবচেয়ে বেশি সোচ্চার বিদেশে থাকা কতিপয় ইউটিউবার, যাঁদের কথা এ দেশে অনেকেই মন দিয়ে শোনেন। গত ১৫ মার্চ এক বক্তব্যে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাইয়ের নেতাদের বলেন, ‘আরও অন্তত পাঁচ-দশ বছর তোমরা আমাদের নেতা থাকো।’ জুলাইয়ের নেতারা কিছু আছেন এখন সরকারে, কিছু সরকারের বাইরে। কাকে তিনি উদ্দেশ করেছেন?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ১০ এপ্রিল বলেন, ‘সাধারণ মানুষ এই সরকারকে আরও পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চাইছে’। সরকারের আরেক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমরা অনির্বাচিত, এই কথা কে বলল?’
এগুলো সরকারের পক্ষে কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টা হয়তো নয়। তবে এই পরিমণ্ডলে আকাঙ্ক্ষা আছে অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘায়িত করার। এনসিপি নেতা সারজিস আলমও সম্প্রতি বলেছেন, ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।’ কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে কোয়ালিশন বা হ্যাঁ-না ভোট—এই সব বিকল্পও তুলে ধরছেন।
যাঁরা এ দেশের রাজনীতিবিদদের ওপর খুব ভরসা রাখেন না, তাঁদের এই সব আলোচনা ও আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। তাই বলে রাজনীতিবিদেরা বসে থাকবেন কেন?
সংস্কার
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। কোথায় কী সংস্কার এবং এতে লাভ কী হবে, তা নিয়ে জনগণ অনেকটা অন্ধকারে। তবে যেটুকু জানা গেছে সংবাদপত্রে, জাতীয় মূলনীতি, জুলাই সনদ ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছে। জাতীয় পরিচিতিও পোক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।
দেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার কী লেখা আছে বা কী লেখা হলে খুব একটা বড় সংস্কার হবে, তা নিয়ে আমরা বেশি সময় নষ্ট করছি। বিশ্বের অনেক দেশে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। কিন্তু তাদের দেশ ও সরকার ভালোভাবেই চলছে।
কাগুজে পরিবর্তনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার গত তিনটা নির্বাচন যেভাবে করেছে, তা বর্তমান সংবিধানের কোথাও লেখা নেই। হাসিনা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতিটাও তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে নাকচ করিয়ে নিলেন।
তাই বলে সংস্কার লাগবে না? অবশ্যই লাগবে, শুধু যেগুলো অর্থবহ হবে দেশের জনগণের জন্য। তার একটা হলো—স্বাধীন বিচার বিভাগ, অন্যটা রাজনীতিবিদদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাঠামো। এই দুই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে দেশ অনেক উপকৃত হবে।
মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ করবে। তাঁর এই উক্তিকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবে একটা নির্বাচন ভালো হলেই সংস্কার সফল হবে, তা ভাবার কারণ নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালে একটা সুন্দর নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। তারপর রাজনীতিকেরা সব তছনছ করলেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের রাজনীতি
- মেরুকরণ