ক. এক শাসকের পতনের পথরেখা
জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের যাত্রাপথ
জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের যাত্রা যে পথে শুরু হয়েছিল, শেখ হাসিনার অচিন্তনীয় এক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত রূপ নেয়। তাঁর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণ–আন্দোলন মোকাবিলায় তিনি ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শিশুসহ সাধারণ নাগরিক এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গুলি করতে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ও নৈতিকতার দিক থেকে অমার্জনীয় এক কাজ করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ, র্যাব ও বর্ডার গার্ডের পথে না হেঁটে সেনাবাহিনী নির্দেশটি মানতে অস্বীকৃতি জানায়। তা না হলে একটি গণহত্যা ঘটে যেতে পারত।
মানুষের ওপর গুলি চালানোর জন্য সেনাবাহিনীকে সর্বশক্তি প্রয়োগের যে নির্দেশ শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী সেটি না মানায় পুরো ঘটনার মোড় বদলে গিয়েছিল। এর পরিণতিতে ৫ আগস্ট ৪৫ মিনিটের নোটিশে তাঁকে গণভবন ছাড়তে হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে রাজি না হওয়ার কারণে সরকার পরিবর্তনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়।
১৯৯০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন সেনাপ্রধান নুরুদ্দিন খান তাঁর সর্বাধিনায়কের (রাষ্ট্রপতি) সমর্থনে সেনা মোতায়েন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে রক্ষায় সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব খারিজ করে দেন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। এর মধ্য দিয়ে তিনি সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহায়তা করতে উদ্যোগী হন। তাঁকেও বেছে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর ভাই মেজর সাঈদ এস্কান্দার আর মইন ইউ আহমেদ ছিলেন একই ব্যাচের।
এসব ঘটনা থেকে মনে হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ রয়েছে, যা ব্যক্তিগত আনুগত্যের ঊর্ধ্বে। ঐতিহাসিকভাবে যখন কোনো অজনপ্রিয় সরকারের সুরক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তখন তা প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের নজির কেমন আছে, আমি জানি না।
যেটি ঘটেছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী তা হলো, শেখ হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। অধ্যাপক ইউনূসের অনুরোধে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ঘটনা অনুসন্ধান করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। জাতিসংঘ পাঁচ শতাধিক পাতার তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে জুলাই ও আগস্টের ঘটনাগুলো নিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে কাজ করবে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত নিজেদের বার্ষিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছে ওএইচসিএইচআর। দেশের নাগরিকদের হত্যার নির্দেশ দেওয়ার জন্য ঢাকায় শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের যে বিচার হতে যাচ্ছে, সেখানেও সাক্ষ্য হিসেবে কাজ করবে এই প্রতিবেদন। তবে ওএইচসিএইচআরের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর সুনির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে, যাতে বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও বাইরের তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা যায়।
শেখ হাসিনার শাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হ্রাস পেতে শুরু করেনি। বিরোধীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, নাগরিকদের গুম, নির্যাতন, গণমাধ্যমের ওপর দমন–পীড়নের মাধ্যমে মানবাধিকারের লঙ্ঘনও শেখ হাসিনার ১৬ বছরের অগণতান্ত্রিক শাসনকে কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূলে যে অপশাসন ছিল, ইউনূসের গঠন করা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও একটি টাস্কফোর্সের তৈরি শ্বেতপত্রে অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে অনেক অপকর্ম চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো পর্দার অন্তরালে থাকা অন্ধকারকে সামনে এনেছে। এসব অপকর্মের মাত্রা হতবাক করে দেওয়ার মতো। তা অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা নাগরিকদের চোখে শেখ হাসিনাকে আরও অবৈধ করে তুলেছিল।
সীমান্তের ওপারের বিচ্যূত দৃষ্টিভঙ্গি
বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার অন্তরঙ্গ পুঁজিপতি চক্রের লাগামহীন দুর্নীতি তাঁর এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করেছে এবং তা নিজেই আমাদের পরিস্থিতি মূল্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার–সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ড, নির্বাচন–জালিয়াতি, মানবাধিকারের পদ্ধতিগত লঙ্ঘন এবং শিল্পপর্যায়ের দুর্নীতি ভারত সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন গণমাধ্যমে ইউনূস–সরকারকে নিয়ে খেয়ালখুশিমতো কথা বলে যাচ্ছেন, শেখ হাসিনার পতন নিয়ে পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক বয়ান প্রচার করছেন। সৌভাগ্যবশত ভারতের সব বিশ্লেষক এই মিথ্যা বয়ানে বিশ্বাস করেন না। যদিও বাংলাদেশের ভারতীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই অভ্যুত্থানের অন্ধকার প্রেক্ষাপট এবং এর পরিণতি সম্পর্কে কম কথা বলছেন বা কিছুই বলছেন না। বর্তমান ঘটনাবলি নিয়ে তাঁদের মন্তব্য যতই ভালো হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা এসব ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা নিচ্ছেন, ততক্ষণ অবধি গল্পটা অসম্পূর্ণ ও ব্যাখ্যাহীন থেকে যাচ্ছে। আর তা বাংলাদেশিদের চোখে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব তীব্রতর করে তুলছে।