বিশ্বায়নের এই যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হলো বিদেশি বিনিয়োগ। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু প্রশ্ন হলো—একটি দেশকে কীভাবে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা যায়?
কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ বা জনসংখ্যা নয়, বরং একটি দেশের রাজনৈতিক ও আইনগত কাঠামো, শাসনব্যবস্থা এবং স্থিতিশীলতাই নির্ধারণ করে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে আগ্রহী হবেন কিনা। যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কিংবা পরিবেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিষয়টি বিবেচনায় আসে তা হলো, একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (Samuel P. Huntington) তার ‘Political Order in Changing Societies’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘Unstable Political systems discourage economic development.’ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যেমন অনির্বাচিত সরকার, বারবার সরকার পরিবর্তন, সামরিক হস্তক্ষেপ, বা সহিংস বিক্ষোভ—এসবই বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। তার মতে, উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হান্টিংটন যুক্তি দেন যে, উন্নয়ন তখনই টেকসই হয় যখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল হয়।
এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা (Francis Fukuyama) যুক্তি দেন যে, strong state capacity, rule of law, এবং democratic accountability—এই তিনের সমন্বয় একটি সফল রাষ্ট্রের ভিত্তি। তার মতে, বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন ‘capable states’—যেখানে প্রশাসন কাজ করে দক্ষভাবে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সীমিত। এছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণ এবং নীতি-নির্ভর প্রশাসন থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। তবুও কিছু বিশেষজ্ঞ যেমন ড্যানি রড্রিক (Dani Rodrik) মনে করেন, বিনিয়োগের জন্য কেবল গণতন্ত্র নয়, ‘Predictable and accountable governance’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
স্বৈরাচার কিংবা একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত হলে সেখানে হঠাৎ নীতি পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে। এ কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এবং স্থিতিশীলতার সংকটও বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা—দুই মিলিয়েই গড়ে ওঠে একটি বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক কাঠামো।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেকোনো দেশে বিনিয়োগ করার আগে সেই দেশের আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে। নিরাপত্তাহীনতা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তায়ন—এসব বিনিয়োগের বড় প্রতিবন্ধকতা। ‘World Bank's Doing Business Index’ অনুযায়ী, যেখানে চুক্তি বাস্তবায়ন সহজ এবং আদালতের কার্যক্রম স্বচ্ছ, সেখানে বিনিয়োগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থ (Douglass North) তার ‘Institutions, Institutional Change and Economic Performance’ তত্ত্বে বলেন, ‘Strong legal institutions reduce transaction costs and uncertainty.’ অর্থাৎ, শক্তিশালী আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং ঝুঁকি কমায়।
এছাড়া, পুলিশের নিরপেক্ষতা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং দোষীদের শাস্তির নিশ্চয়তা—এসব উপাদান সরাসরি বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ হ্যারল্ড ডেমসেটজ (Harold Demsetz) তার ‘Transaction Cost Economics’ তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রশাসনিক জটিলতা ও ঘুষ লেনদেন বিনিয়োগের ‘লেনদেন ব্যয়’ বাড়ায় এবং উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন। যদি কোনো দেশে এক উইন্ডো সার্ভিস, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুমোদন, স্পষ্ট নীতিমালা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যবস্থা থাকে, তবে বিনিয়োগকারীরা সেখানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে আসতে পারেন।