চারুকলার শোভাযাত্রা: আনন্দে ঝরে গেল মঙ্গল!

বিডি নিউজ ২৪ চিররঞ্জন সরকার প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২২:৪০

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রাটি দেশবাসীর কাছে এক দৃষ্টিনন্দন ঐতিহ্যের অংশ। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলার নববর্ষ মানেই চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টিশীল শিল্প, লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক, আর শত সহস্র মানুষের মিলে-মিশে শুভ, কল্যাণ, সুন্দর আর মানবিক জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে রাজপথে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো যাকে ‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই শোভাযাত্রা— যার জন্ম হয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের গর্ভে, আজ হঠাৎ করেই তার নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে। একদল নব্য-জ্ঞানী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন আর ‘মঙ্গল’ নয়, ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে হবে। খেয়াল করুন, শব্দটা বদলেছে— ভাবটা না। ঠিক যেমন আগের দিনে রাজা নাম বদল করে সিংহাসন রক্ষা করতেন, আজকের বুদ্ধিজীবীরা শব্দ বদলে সংস্কৃতির গলা টিপে ধরছেন, যাতে আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, এবং প্রগতিশীলতা— সব একসাথে হাঁপিয়ে পড়ে, কোমা তে চলে যায়!


ওই পণ্ডিতদের মতে, ‘মঙ্গল’ শব্দটাকে সাবেক শাসকরা কলুষিত করে ফেলেছিল! অতএব, শোভাযাত্রার নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে অনেক দিন ধরেই এক শ্রেণির মানুষের আপত্তি ছিল। শুভবোধ, মানবিকতা, সর্বজনীনতা— এই শব্দগুলো যতই চারুকলার রঙে আর কল্পনায় প্রাণ পাক, ‘মঙ্গল’ শব্দটার সমস্যা হলো, ওটা হিন্দুয়ানি, পুরাতন, ওটা ধ্রুপদি, ওটা নাকি অতিরিক্ত পবিত্র! তাই এখন থেকে 'মঙ্গল’ নয়, হবে 'আনন্দ'। অথচ একটু খোঁজ করলেই দেখা যায়, 'আনন্দ' শব্দটাও কিন্তু সেই একই শিকড় থেকে উঠে এসেছে— সংস্কৃত ভাষার ‘আনন্দ’, যার স্থান ভগবদ্গীতা থেকে উপনিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে চিরন্তন সুখ মানেই ‘আনন্দ’। একজন মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মিক মিলনে যে পূর্ণতা লাভ করে, সেটাকেই আনন্দ বলা হয়। সেটা কি করে মেনে নিচ্ছেন এই নাম-পরিষ্কারক দল? কী তাদের সূত্র—‘আনন্দ’কে তারা কি নবধর্মীয় রিক্রুট করেছেন নাকি আধুনিক কালিতে নতুন ব্যাখ্যা লিখে দিচ্ছেন? তা হলে কী এই শব্দ বদলের তর্জন-গর্জন আসলে নিরপেক্ষতার নামে একপাক্ষিক অপসারণ?


তবে এদের যুক্তি যুক্তির মতো না, বরং পুরনো আমলের সেই লোকটার মতো, যিনি বাড়ির জানালায় আগুন দেখে বলেছিলেন, “আগুন তো লাল, লাল তো কমিউনিস্ট রং, নিশ্চয়ই এ আগুন রাশিয়ার ষড়যন্ত্র!” এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়া যেন বাংলা সংস্কৃতিকে জেলখানার ইউনিফর্ম পরিয়ে দিচ্ছে। শোভাযাত্রার রাজহাঁস, মাছ, মুখোশ, হাতি— সব কিছুই যেখানে প্রতীক হয়ে এসেছে মানুষের মঙ্গলকামনা, কল্যাণ ও শান্তির, সেখানে শব্দটাকেই কেটে ফেলা মানে হলো, মূল ভাবনাটাকেই অপমান করা। যেন কেউ সুন্দর একটি গানের একটা লাইন কেটে দিয়ে বলছে— “এই লাইনটা সমস্যাযুক্ত, কারণ এটা বেশি আবেগপ্রবণ।” অপযুক্তি যে কেমন করে পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে নিজেকে ঢাকে, এই বদল তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।


চারুকলার এই শোভাযাত্রা শুরু থেকে ছিল এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ, লাল মাটির মতো জমাট প্রতিবাদ, ঢাকার রাজপথে ধ্বনিত এক সৃষ্টিশীল চিৎকার। তখনকার চারুকলা জানত, মঙ্গল শব্দ মানে শুধু ধর্ম নয়— এটা শুভ, কল্যাণকর, এক জাতীয় মেটাফোর। তাদের চোখে শোভাযাত্রার হাতি, ঘোড়া, মাছ, মুখোশ সব কিছুই ছিল প্রতীক— মানবতাবাদের, অসাম্প্রদায়িকতার, জনগণের মঙ্গলচিন্তার। এখন সেই শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’কে ছেঁটে ফেলে বলা হচ্ছে, এটা নাকি ‘রাজনৈতিক’ হয়ে গেছে।


কে যেন বলেছিল, রাজনীতি আর ধর্ম যদি একসাথে চলতে থাকে, তাহলে ইতিহাস পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বেসিনে দাঁত মাজতে শুরু করে। এখন মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদল করে যেন ইতিহাসের দাঁতই ফেলে দেওয়া হচ্ছে! আজ যারা এই শোভাযাত্রার নাম বদল করছেন, তারাই একদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতেন— “সংস্কৃতি কারো সম্পত্তি নয়।” আজ তারা বলছেন— “এই শব্দটা কারো ধর্মীয় উৎসের, তাই সরিয়ে দাও।” অথচ এই মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্যকে সামনের কাতারে রেখে। উদ্যোক্তারা বলেছিল— এই শোভাযাত্রা দল বা মতের নয়, এটা জাতির, এটা বাঙালির।


তাহলে আজ যে এই নাম বদলের মঞ্চে বসে থাকা সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা বলছেন— ‘মঙ্গল’ মানে সংকীর্ণতা, তারা কি এই শোভাযাত্রাকে আবার সংকীর্ণ করারই চেষ্টায় ব্যস্ত? তারা কি আদতে সেই সর্বজনীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, যেটা এই উৎসবের প্রাণ ছিল?

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও