
২০২৫-এর প্রাক-বাজেট আলোচনায় কয়েকটি মন্তব্য ও প্রস্তাব
১. যেকোনো প্রস্তাব, তা বর্তমান অবস্থা চলমান রাখার জন্য হোক অথবা তা পরিবর্তনের জন্য হোক, অথবা নতুন কোনো রীতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে হোক, গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের ক্ষেত্রে তার পটভূমি, চলমান অবস্থার অযৌক্তিকতা বা যৌক্তিকতার ভিত্তিতে তা পরিবর্তন বা অপরিবর্তিত রাখার কারণ এবং নতুন প্রস্তাবের তাৎপর্য উল্লেখ করা রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। শেষোক্ত ক্ষেত্রে রাজস্ব, খরচে সাশ্রয়, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি এবং বৈষম্য কমানোতে উদ্যোগটির তাৎপর্য বিবেচনায় নেয়া হবে বলে আশা করব। সর্বোপরি, প্রস্তাবিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সুবিধা-অসুবিধা ধর্তব্যে আনা প্রয়োজন।
২. সেবাদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অগ্রগতি দেখা গেলেও এখনো এ বছর থেকে অনলাইনে কর জমা দেয়ার আশায় আছি। তবে কয়েকটি সহজলব্ধ কাজে অগ্রগতি হচ্ছে না কেন, সেটা আমাকে অবাক করে। যেসব পারাপারে (যেমন সেতু পারাপার) সরকার আরোপিত টোল ধার্য রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে টোল কেন্দ্রে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করে স্থানীয়ভাবে মোবাইলভিত্তিক সফটওয়্যার প্রয়োগে টোল সংগ্রহ কার্যকরে বিলম্ব দেখছি। সার্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার চিহ্নিত করে যেসব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হবে তা চালু করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট সংস্থার অর্থায়ন ও সহায়তায় স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ সেবা চাহিদা মেটাতে প্রয়োগধর্মী সফটওয়্যার (software application) উন্নয়নের জন্য (ডেডিকেটেড) বিনিয়োগ জরুরি। এটা করতে পারলে লাইসেন্স ফির নামে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি ও স্থানীয় চাহিদার আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠা করে দেশীয় অর্থনীতিকে মজবুত করা সম্ভব। ট্রাফিক সিগন্যাল তৈরিতে ক্ষণেকের সৃষ্ট স্বপ্ন কি অংকুরেই বিনষ্ট হলো, তা জানা নেই।
৩. এটা অনস্বীকার্য যে গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্রতর হওয়ায় এবং আমাদের সমাজে একই মাত্রায় বিভক্তি আসায় তথ্যের এবং কৌশলের গোপনীয়তা রক্ষা করা অনেক সময় জরুরি হতে পারে। তথাপি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তথ্যের উন্মুক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি। মাত্র একটি উদহারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করব;
হঠাৎ একদিন কর পরিদর্শন বিভাগ থেকে ফোনকল এল। জানাল যে প্রায় ছয় মাসের অধিককাল আগে আমাকে নোটিস দেয়া হয়েছিল কোনো এক আপিল রায়ে ধার্যকৃত ফাইন উল্লেখ করে। অর্থাৎ সে সময়েরও আগে নিশ্চয়ই আমাকে পুরনো কোনো এক রিটার্নসে ব্যত্যয় দেখিয়ে কারণ দর্শানো নোটিস দেয়া হয়েছিল, যার ভিত্তিতে আপিল রায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এবং পরিদর্শন দল সরজমিনে আমার/আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে এসেছে। এসব কিছুই ছিল আমার অগোচরে।
করদাতার সঙ্গে কর অফিসের সব ধরনের যোগাযোগে স্বচ্ছতা আনা জরুরি। গোপনীয়তার নামে অনৈতিক লেনদেনের গোপনীয়তা রক্ষার দিন শেষ হওয়া প্রয়োজন। সেই স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য করণীয় সম্পর্কে পৃথক আলাপ হতে পারে। এ পর্যায়ে দুটো প্রস্তাব :
(ক) করদাতাকে প্রেরিত প্রতিটি নোটিসে প্রেরকের নাম, সরকারি মোবাইল নম্বর ও সরকারি চালু ই-মেইল ঠিকানা দিতে হবে। ই-মেইলের মাধ্যমে শুধু নির্দেশ-সংক্রান্ত প্রশ্ন ও ব্যাখ্যাদান বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন।
(খ) কম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু তথ্য আছে যা সহজে একজন করদাতা, শুধু ই-টিন এবং কর-অঞ্চলের নম্বর (বা সহজ অন্য কোনো তথ্য) দিয়ে দেখতে পাবে। সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স এবং রাজউকের প্লট-সংক্রান্ত তথ্যাদি দেখতে পাওয়ার সহজ ব্যবস্থা রয়েছে। কর পোর্টালে একজন করদাতা যেন সহজে তার জমাকৃত রিটার্নসের সর্বশেষ অর্থ বা কর বছর এবং সেই সঙ্গে তার কাছ থেকে কর অফিসের চাহিদা বা নোটিস সম্পর্কে জানতে পারে। ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করে এ তথ্য-তালিকা দীর্ঘায়িত সম্ভব।
বর্তমান ‘সেবা তালিকা’ দেয়ার মাধ্যমে যে দায়মুক্ত থাকার পথ এনবিআর বেছে নিয়েছে তা স্বচ্ছতা আনে না। বরং ব্যক্তি করদাতা ও কর অফিসের লেনদেনে স্বচ্ছতা আনা জরুরি।
৪. রাজস্ব বা কর/অনুদান নীতি ও রাজস্ব বা কর আদায়ের নীতির মাঝে ভিন্নতা আনার কথা গত প্রায় ২০ বছর ধরে বলছি। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে শুনেছি। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি। আমি এ দুই স্তরের নীতির সঙ্গে এক বা একাধিক সংস্থার সম্ভাবনা দেখি।
তবে অধিক জরুরি হলো নীতি প্রয়োগকারী অর্থাৎ যারা কর আদায় করবেন বা সেই আদায়ের তদারকি করবেন, তাদের থেকে নীতি প্রণয়নকারীদের মতবিনিময় হতে পারে, তবে নির্বাহী যোগসূত্রটা থাকা কাঙ্ক্ষিত নয়।
৫. অনেককেই উন্নয়ন দর্শনের ওপর ঢালাও মন্তব্য করতে শুনি। এ ব্যাপারে পৃথক মতবিনিময় হলে আমার মত ব্যক্ত করব যদিও পত্রিকা ও আলোচনায় আগে বলেছি। এ বাজেটে সংক্ষিপ্তাকারে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন দর্শন/ভাবনা লিপিবদ্ধ করলে উপকৃত হব।