
পুতিনের শর্তেই শেষ হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপের মধ্য দিয়ে এই আলোচনার সূচনা করেন। এরপর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ও তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তারা মুখোমুখি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে উভয় দেশের পক্ষ থেকে আলোচনাকে সন্তোষজনক মন্তব্য করে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে আরো আলোচনা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে কী শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে, তা কোনো পক্ষই স্পষ্ট করেনি। এ বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ বলেছেন, রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের যে চারটি প্রদেশ দখল করে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না, নিরপেক্ষ থাকবে—এই মর্মে ইউক্রেনকে অঙ্গীকার করতে হবে।
আর ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে হবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে এটি স্পষ্ট যে রুশ শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের আপত্তি নেই। আলোচনার পর মার্কিন কর্মকর্তারা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
অবশ্য এই ইঙ্গিত নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চ ও এপ্রিলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইস্তাম্বুলে যে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির আলোচনা শুরু হয়, তখনো এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত হেনরি কিসিঞ্জার ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে অবিলম্বে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের কথা বলেন। ওই বছর ২৪ মে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে কিসিঞ্জার আবারও তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, অহেতুক হানাহানি না বাড়িয়ে ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার দাবি মেনে নেওয়া।
রাশিয়া যে জায়গা দখল করেছে তার মালিকানা ছেড়ে দেওয়া। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে রাশিয়াকে পরাস্ত করা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই হুমকির মুখে পড়বে ইউক্রেন। সেই সময় ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে সম্মত হলেও শেষ মুহূর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত হয়। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘আজ হোক, কাল হোক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকে বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ অর্থাৎ শান্তির লক্ষ্যে ইউক্রেনকে তার নিজ ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
উল্লেখ্য, সেই সময় যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার শর্ত ছিল—১. ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে। ২. ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নািস প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ৩. দেশটির নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
ওই সময় শান্তিচুক্তির স্বার্থে রাশিয়া তার সামরিক অভিযানের লাগাম টেনে ধরে। কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং চেরনোহির দখল ছেড়ে দিয়ে সেনাদের রুশ সীমান্তের কাছে ফিরিয়ে নেয়। এ বিষয়ে তৎকালীন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোবিন বলেন, ‘সমঝোতার পথ তৈরির জন্য সেনা সরানো হয়েছে।’ সমঝোতা হলেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন শান্তিচুক্তিতে সই করা থেকে বিরত থাকে এরই মধ্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি।
সেই সময় যা ঘটেছিল তা হলো—২৯ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন সম্মত হয়। এবং পরদিন ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তি আলোচনা রাশিয়ার কূটকৌশল। ওয়াশিংটন এই কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেবে না। ভণ্ডুল হয়ে গেল শান্তি আলোচনা। টেবিলেই পড়ে থাকে চুক্তির খসড়া।
তারপর দীর্ঘ লড়াই। তিন বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াই। এই লড়াইয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়াসহ চারটি প্রদেশ ও ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ দখল করে নিয়েছে। এই ভূখণ্ডের পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেছে রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির শর্ত। কারণ এই সময়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকাকে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে ডিক্রি জারি করেছেন। অবশ্য গণভোট করে ওই অঞ্চলের জনগণের মতামত নিয়ে।