
যুদ্ধবাজদের ফাঁদ থেকে ইউক্রেইনের মুক্তি কোন পথে?
যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু হয় তার আর শত্রু দরকার হয় না— কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তার দেশ ইউক্রেইন। এবার ২৪ ফেব্রুয়ারি কিয়েভে আয়োজিত রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ৩ বৎসর পূর্তিতে আয়োজিত সভায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি পাঠায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জেলেনস্কি কেবল বিশ্বাসঘাতকতারই শিকার হলেন না— তারচেয়েও বেশি। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তার কাছ থেকে ইউক্রেইনের ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজসম্পদের ওপর অধিকার দাবি করেছেন। তারা তাকে এই যুদ্ধ শুরু করার জন্যও দায়ী করছেন। অভিযুক্ত করছেন যে, তিনি একজন একনায়ক যে কৌশলে নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার জন্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিয়ে চুক্তি করতে জেলেনস্কি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে ওয়াশিংটনে যান। সেখানে পারস্পরিক বাকবিতণ্ডা কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে পরিণত হয় ও সভাটি ভেস্তে যায়। ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে রীতিমত ধমকে দিলেন জেলেনস্কিকে। জেডি ভ্যান্সের উগ্রতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জেলেনস্কি মার্কিন সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানালেও ভ্যান্স তার কাছ থেকে ট্রাম্পের জন্য ক্রমাগত কৃতজ্ঞতা দাবি করতে থাকেন।
২০২২-এর ফ্রেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন আক্রমণের পর ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিন দিনের মধ্যে রাজধানী কিইভ দখলের। তার ওই আশা পূরণ হয়নি। বরং এক পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা ৩ বছর ধরে যুদ্ধ করছে। অবশ্য ইতিমধ্যে দেশটি ২০ শতাংশ ভূখণ্ড হারিয়েছে রাশিয়ার কাছে। নিহত হয়েছে ইউক্রেইনের ৪৬ হাজার সৈন্য এবং আরও অসংখ্য বেসামরিক মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন। এতকিছুর পরও দেশটি মাথা নত করেনি।
তবে এ কথাও ঠিক যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেইনের কখনো জেতার সম্ভাবনা ছিল না, আর এখন তো একেবারেই নেই। দেশটি আত্মরক্ষার এই যুদ্ধ করেছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতায়। তাছাড়া প্রতিদিনই দেশটি বেশি বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ঠিক এরকম একটা পরিস্থিতিতে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেইনের ওপর থেকে সমস্ত সমর্থন প্রত্যাহার করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এই হঠাৎ বিপরীতমুখী পরিবর্তন সামরিকভাবে পরাক্রমশালী একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি দেশকে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
পুতিন তো ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি তাকে ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিলেন। অতএব পুতিনের ব্যাপারে ট্রাম্প সত্য কথাই বলেছেন যে, এ যুদ্ধ পুতিন শুরু করেননি, আর সেইসঙ্গে মিথ্যাও বলেছেন যে, এ যুদ্ধের হোতা জেলেনস্কি। ট্রাম্প যে সত্য কোনোদিনই বলবেন না, তা হচ্ছে, এই যুদ্ধ আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের উস্কানির ফল।
এ ব্যাপারে পিয়ার্স মরগ্যানের আনসেন্সরডসহ বহু অনুষ্ঠানে বিশ্বখ্যাত মানবতাবাদী মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকসের দেওয়া একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য, যেখানে তিনি বলেন: ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির একত্রীকরণের কালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, ন্যাটো পূর্বদিকে এক ইঞ্চিও সম্প্রসারিত হবে না। এরপরই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতারণা। ১৯৯৪ সালেই বিল ক্লিনটন ঘোষণা করেন যে, ন্যাটোর সম্প্রসারণে কেউ বাধা দিতে পারবে না। পরিকল্পনা করা হয়, একেবারে রাশিয়ার নাকের ডগা পর্যন্ত এই যুদ্ধ জোট সম্প্রসারণের। ১৯৯৯ সালেই হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রকে ন্যাটোর সদস্য ঘোষণা করা হয়। এরপর সাবেক সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকেও একে একে ন্যাটোর সদস্য করার উদ্যোগ শুরু হয়। এভাবে ইউক্রেইনের সামনে ন্যাটো সদস্য হওয়ার মূলা ঝুলানো হয়। যা পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।